সন্ধের সময় আমি আমার হোটেলে ফিরে এসে রাতের খাওয়া খেলাম। অ্যাডেলিন এসে আমাকে বলল, তুমি খুব রেগে গিয়েছিলে। কাউন্ট তোমাকে সভা। ত্যাগ করতে বলেছিল। আমি বললাম, বাইরের আলো-হাওয়ায় এসে আমি খুশি হই। কিন্তু অ্যাডেনিল বলল, আমার খারাপ লাগছিল। ওরা সবাই তোমার কথা বলাবলি করছিল। এতে আমার রাগ আরও বেড়ে যায়।
এইভাবে আমি দুষ্ট গ্রহের মতো যেখানে যাচ্ছি সেখানেই সবাই করুণা করছে। তুচ্ছ ভাবছে। ওই সব অপদার্থ অহঙ্কারী লোকগুলো অকারণে আমার সম্বন্ধে যা তা বলবে এটা আমি চাই না। কোনও লোকই তা সহ্য করতে পারে না।
মার্চ ১৬,
আমার সব কিছুই খারাপ লাগছে। এখানে সব কিছুই যেন ষড়যন্ত্র করছে আমার বিরুদ্ধে। আজ ফ্রনিলের সঙ্গে দেখা হলো। আমি তাকে ডেকে আমার প্রতি তার সেদিনকার দুর্ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলাম। ফ্রনিল তখন বলল, কিছু মনে করো না ওয়ার্দার। আমি তোমাকে ঐ ভোজসভায় দেখেই চিন্তিত হয়ে পড়ি। দুজন মাদাম অর্থাৎ সম্ভ্রান্ত মহিলা তোমাকে দেখে চলে যাচ্ছিল ভোজসভা থেকে। কাউন্ট মুস্কিলে পড়েছিলেন, কারণ তিনি তাদের সঙ্গে মনোমালিন্য করার ঝুঁকি নিতে পারছিলেন না। তখন আমার মনে কি দারুণ কষ্ট হচ্ছিল তা তোমায় বোঝাতে পারব না।
আমি দেখলাম কথা বলতে বলতে চোখ দিয়ে জল পড়ছিল ফ্রলিনের। সত্যিই সে দুঃখ পেয়েছিল আমার জন্য। ফ্রলিন আর বলল, সবচেয়ে দুঃখের বিষয় সেই ভোজসভায় আমার পিসিও ছিলেন। তিনি আমাকে পরে তোমার সঙ্গে মেলামেশার জন্য আমাকে অপমান করলেন। তোমার নামেও যা তা বলতে লাগলেন। কিন্তু তোমার সমর্থনে আমি খুব বেশি কথা বলতে পারলাম না।
ফ্রলিনের প্রতিটি কথা তীক্ষ্ণ ছুরির মতো আমার বুকে বিঁধছিল। সে বলল, এই নিয়ে আরও কথা হবে। হিংসুটে লোকগুলো অনেক কানাঘুষো করবে আমাকে নিয়ে। উইলেম, ফ্রলিনের কণ্ঠে প্রকৃত সহানুভূতির স্পষ্ট আভাস পেয়ে সত্যিই আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল একটা ছুরি নিয়ে আমার বুকে আমূল বসিয়ে দিই। আমার নিজের চোখে আমার নিজের রক্ত দেখলেই আমি শান্ত হব চিরদিনের জন্য। এ ছাড়া কোনও উপায় নেই। এক ধরনের ঘোড়ার কথা শুনেছি যারা খুব রেগে গেলে বা ক্লান্ত হয়ে নিজেদের দেহের শিরা কামড়ে আত্মহত্যা করে। আমারও তাই ইচ্ছা হচ্ছিল নিজের দেহের শিরা ছিঁড়ে চিরমুক্তি লাভ করি।
মার্চ ২৪,
আমি কাউন্টের কাছে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছি। মনে হয় তা গৃহীত হবে। তোমার মতামত চাইতে না পারার জন্য ক্ষমা চাইছি। প্রথম কথা আমাকে অন্যত্র যেতে হয়েছিল। দ্বিতীয় কথা তোমার মত চাইলে তুমি আমাকে থাকতে বলতে। মাকে সব কথা বুঝিয়ে বলো। তাঁকে সব কিছু সহ্য করতেই হবে। কারণ এ ছাড়া আমার করার কিছুই নেই। ভবিষ্যতে প্রিভি কাউন্সিল বা রাষ্ট্রদূত অফিসের ভালো পদের আশা ত্যাগ করে তাঁর পুত্র চলে গেল। যাই হোক, আমি যাচ্ছি। জনৈক রাজকুমার…আমার সাহচর্য চান। তিনি আমাকে তাঁদের দেশের বাড়িতে গিয়ে বসন্তকালটা কাটাবার কথা বলছেন। মোটামুটি আমাদের মধ্যে কিছুটা বোঝাপড়া হয়েছে। দেখা যাক ভাগ্য পরীক্ষা করে।
এপ্রিল ১৯,
তোমার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আমি তোমার দুখানি চিঠিই পেয়েছি। কিন্তু উত্তর দিতে পারিনি। আমার ভয় হচ্ছিল আমার মা যদি মন্ত্রীর কাছে দরখাস্ত করেন তাহলে আমার পদত্যাগপত্র সহজে গৃহীত হবে না। যাই হোক, এখন সব কিছুর শেষ। হয়ে গেছে। বিশেষ অনিচ্ছার সঙ্গে মন্ত্রী মহোদয় আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। তাঁর চিঠিখানা পড়লে তোমার সত্যিই কষ্ট হবে। রাজকুমার আমাকে একখানি চিঠির সঙ্গে পঁচিশটি ডুকেট দান করেছেন। সুতরাং মাকে যে টাকা পাঠানোর কথা লিখেছিলাম তা না পাঠালেও চলবে।
মে ৫,
আমি আগামীকাল এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আমার আমার জন্মস্থানে বেড়াতে যাব। আমার বাবার মৃত্যুর পর মা আমাকে নিয়ে যে বাড়ি থেকে চিরদিনের মতো বেরিয়ে আসেন সেই বাড়িটা আমার দেখব আমি। বিদায় উইলেম, পরে আবার সব জানাচ্ছি।
মে ৯,
তীর্থযাত্রীর মতো নিবিড় শ্রদ্ধার সঙ্গে আমি আমার জন্মভূমি দর্শন করেছি। আমি আমার তীর্থযাত্রা শেষ করেছি। সেখানে পৌঁছে গাড়িটা দূরে রেখে পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলাম আমি। কত বিচিত্র আবেগানুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল আমার অন্তর। সেই লাইম গাছটার তলায় দীর্ঘকাল পরে আবার দাঁড়ালাম। একদিন যখন ছোট ছিলাম, যখন বাইরের জগৎ সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণা ছিল না, আমার ছোট মনে তখন কত আশা ছিল, কত স্বপ্ন ছিল। আর আজ যখন বাইরের জগৎ থেকে ঘা খেয়ে ফিরে এলাম। সেই জায়গায় তখন আমার সব আশা সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ছেলেবেলায় যে স্কুলটায় পড়তাম এখন সেটা এক দোকান ঘরে পরিণত হয়েছে। আমাদের পুরনো। বাড়িটার পাশে একটা হোটেলে উঠলাম আমি। শহরের বাইরে নদীর ধার দিয়ে বেড়াতে গেলাম। নদীর ধার আর খামারবাড়ি দিয়ে কত বেড়াতে যেতাম। তখন অবারিত মাঠ আর মুক্ত আকাশ দেখে ইউলিসেসের মতো মনে হতো সমুদ্র-মেখলা পৃথিবী অনন্ত, আর শেষ নেই, সীমা নেই। আজকালকার ছেলেরা শেখে পৃথিবী গোল এবং তাদের কাছে পৃথিবী কত ছোট।
আমি রাজকুমারের শিকারের জায়গায় এসে গেছি। লোকটি সত্যি খুব ভালো। কিন্তু যখন শুনলাম উনি সাধারণত বই পড়ে আর লোকের মুখ থেকে শুনে সব জ্ঞান লাভ করেন তখন একটু দুঃখ পেলাম। আর একটা দুঃখের কথা, উনি আমার অন্তরের থেকে বুদ্ধির উপরেই গুরুত্ব দেন বেশি। কিন্তু উনি জানেন না আমার যা কিছু সম্পদ তা সব আছে আমার অন্তরে।