জানুয়ারি ৮,
কতকগুলো মানুষ আছে যারা প্রথাগতভাবে তাদের কাজকর্ম চিরকাল যথারীতি করে যেতেই ভালোবাসে। যাদের জীবনে লক্ষ্য ও ভাবধারার কোনও পরিবর্তন হতে চায় না কখনও। তারা কোনও সুযোগ পেলেও গ্রহণ করতে চায় না। গত সপ্তায় একজনের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে যায়। যারা আসন বা পদটাকে গুরুত্ব দেয় তারা বোকা। রাজাদের পদ সবচেয়ে বড় হয়েও মন্ত্রীদের দ্বারা চালিত হয় আর মন্ত্রীরা চালিত হয় তাদের সচিবদের দ্বারা। যারা বুদ্ধি ও চাতুর্যের দ্বারা অন্যদের নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কাজে লাগাতে পারে, তারাই মানুষ।
জানুয়ারি ২০,
আজ আমি তোমাকে চিঠি লিখব লোত্তে। ঝড়ের প্রকোপ হতে নিজেকে বাঁচাবার জন্য আজ এই পান্থশালাটার একটা ছোট্ট ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আজ এখান থেকেই চিঠি লিখব তোমায়। আমি যখন শহরের পথে এগিয়ে চলেছিলাম আর পাঁচজনের সঙ্গে তখন তোমার কথা মনে হয়েছিল আমার। তারপর ঝড় উঠতেই এলাম। ঘরে ঢুকতেই তোমার ছবি ভেসে উঠল মনে।
আজ যদি তুমি আমায় দেখতে তাহলে একেবারে অবাক হয়ে যেতে। আজ আমার মনে আর সেই আবেগের বন্যা নেই। সব শুকিয়ে গেছে। আজ আমার মনের মধ্যে কোনও আবেগ বা অনুভূতিকে লালন করার মতো সময় নেই। ফ্রলিন নামে একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে আমার। তাকে দেখতে তোমার মতো। সে বলে আমার আচরণ নাকি খুব দ্র ও মাজির্ত। মাঝে মাঝে আমরা দুজনে বসে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করি। তোমার কথা বণি আমি প্রায়ই। সে তোমাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে।
হায়, আজ ঠিক এই মুহূর্তে আমি যদি তোমাদের সেই ঘরে বসে থাকতাম তোমার কাছে। তোমার ভাই-বোনেরা খুব বেশি জ্বালাতন করলে আমি তাদের ডেকে বেশ কেমন একটা রূপকথার গল্প শোনাতাম। এখন বরফে ঢাকা প্রান্তরের উপর সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ঝড় সবেমাত্র শেষ হয়েছে। আমাকে এরই মধ্যে ঘরের খাঁচায় ঢুকতে হবে? আলবার্ট কি এখন তোমার কাছেই আসবে? বিদায়! কেমন আছ তোমরা?
ফেব্রুয়ারি ১৭,
আমার ভয় আমি আমার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বেশিদিন মানিয়ে চলতে পারব না। ভদ্রলোক সত্যিই অসহ্য। তাঁর কাজ করার পদ্ধতিটি একেবারে হাস্যকর, কথায় কথায় তাঁর কাজের প্রতিবাদ না করে পারি না। আর আমি প্রায়ই নিজের মতো করে কাজ করে যাই যা তাঁর মোটেই ভালো লাগে না। সম্প্রতি তিনি রেগে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন মন্ত্রীর কাছে। আমি তাতে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিই। মন্ত্রী তখন ব্যক্তিগত পত্র মারফৎ আমাকে ডেকে পাঠান। আমাকে শান্ত হতে বলেন। অনেক করে বোঝান। তার মনটা সত্যিই উদার এবং মহৎ। এখন আমি অনেকটা আত্মস্থ হতে পেরেছি। এর মতো শান্তির আর কিছু হতে পারে না।
ফেব্রুয়ারি ২০,
ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন। যে সুখ আমার কেড়ে নিয়েছেন সে সুখ যেন তোমরা পাও।
আলবার্ত, তুমি আমাকে ঠকিয়েছ। আমি আশা করেছিলাম তোমার বিয়ের খবরটা জানাবে। তাহলে সেদিন আমি আমার ঐ দেওয়ালে টাঙানো লোত্তের ছবিখানা নামিয়ে আমার পুরনো কাপজপত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতাম। তোমাদের বিয়ে যখন হয়ে গেছে তখন ও ছবিটার ওখানে থাকার কোনও আর অর্থ হয় না। আবার ভাবি থাকণেই বা। আমি তো লোত্তের অন্তরে তোমার পাশেই বিরাজ করছি। লোত্তে যদি আমাকে ভুলে যায় তাহলে হয়ত পাগল হয়ে যাব আমি। এই ধরনের নাটকীয় চিন্তা যেন আমার মনে না আসে। বিদায় আলবার্ত। বিদায় লোত্তে।
মার্চ ২৫,
এখানেও আমি এমন এক দুঃখের কবলে পড়েছি যে এখান থেকে চলে যেতে হবে আমায়। আমার নিজের দাঁত নিজেই ভাঙতে ইচ্ছে করছে। এর কোনও প্রতিকার নেই। সব দোষ তোমাদের। তোমরাই আমাকে এমন এক পদ গ্রহণ করতে বাধ্য করেছ যে পদ গ্রহণ করতে মন আমার চায়নি। কিন্তু তোমরা যাতে আমাকে দোষ দিতে না পার, যাতে বলত না পার আমার আবেগের আতিশয্য সব কিছু মাটি করে ফেলেছে তার জন্য আমি একটা কাহিনীর উল্লেখ করছি।
আমি তোমাদের আগেই বলেছি কাউন্ট আমাকে ভালোবাসেন। গতকাল তাঁর বাড়িতে সম্ভ্রান্ত অভিজাত পরিবারের লোকজনের উপস্থিতিতে সমৃদ্ধ এক ভোজসভায় যোগদান করি। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম এ ধরনের ভোজসভায় আমার মতো লোকের যোগদান করা সাজে না। আমি হলঘরে কাউন্টের সঙ্গে পায়চারি করতে করতে কথা বলছিলাম। এমন সময় কোনও এক মহিলা তার স্বামী ও কন্যাকে নিয়ে ঢুকলেন। এ পরিবেশ আমার ভালো লাগছিল না। আমি চলে যাবার কথা ভাবছিলাম, এমন সময় ফ্রলিন নামে আমার পরিচিত সেই মেয়েটি এল। তাকে দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। কিন্তু সে অন্যদিনকার মতো প্রাণ খুলে কথা বলল না আমার সঙ্গে। এর কারণ আমি বুঝতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম না ফ্রলিন এই ধরনের পরিবেশ ভালোবাসে কি না। চলে যেতে গিয়েও যেতে পারলাম না আমি। এদিকে একের পর এক তথাকথিত সম্মানিত অতিথিরা আসতে লাগল। ব্যারন, কর্নেল, কাউন্ট প্রভৃতি কত সব উজ্জ্বল পোশাক পরা গণ্যমান্য অভিজাত সমাজের ব্যক্তিরা। আমি ক্রমশই হাঁপিয়ে উঠছিলাম। মহিলারা আমার অবস্থা দেখে এক কোণে নিজেদের মধ্যে কি সব বলাবলি করছিল। কাউন্ট একসময় আমাকে জানালার ধারে নিয়ে নিয়ে বললেন, ওঁরা তোমাকে এখানে দেশে বিস্ময় ও অস্বস্তি বোধ করছেন। কিন্তু আমি কিছুই–। আমি তখন কাউন্টকে বললাম, আমি আগেই এটা অনুভব করেছি। আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি যাচ্ছি। কাউন্ট সহানুভূতির সঙ্গে আমার হাতে চাপ দিলেন। আমি সভা থেকে অসময়ে বিদায় নিয়ে বাইরে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। বাইরে এসে একটা ঘোড়ার গাড়িতে করে পাহাড়ে সূর্যাস্ত দেখতে চলে গেলাম। হোমার পড়তে লাগলাম।