লোত্তে বলল, আবার কাল দেখা হবে হয়ত। কাল’ এই কথাটা শুনে আমার বড় দুঃখ হলো। সে জানত না আমার চলে যাবার কথা।
আমি সেইখানে স্তব্ধ ও বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। ওরা দুজনে চাঁদের আলোভরা উপত্যকার উপর দিয়ে হেঁটে গেল ধীর পদক্ষেপে। একটু দূরে গেলে আমি মাটির উপর শুয়ে কাঁদতে লাগলাম। কিছু পরে উঠে আবার এগিয়ে গেলাম। দেখলাম সাদা ফ্ৰকপরা লোত্তের মূর্তিটা বাগান পার হয়ে মিলিয় যাচ্ছে ওদের বাড়ির সদর দরজায়। আমি দুটো হাত শূন্যে বাড়িয়ে দিলাম।
অক্টোবর ২০,
আমি গতকাল এখানে এসেছি। রাষ্ট্রদূত অসুস্থ থাকার জন্য দিনকতক বাড়িতে বিশ্রাম করবেন। তিনি যদি নির্দয় না হন তাহলে সব ভালোভাবে চলবে। কিন্তু আমি দেখছি আমার দুঃখ আছে। তবু সাহস অবলম্বন করতে হবে আমাকে। হায়, আমার অন্তরটা যদি একটু হাল্কা হতো। হে ঈশ্বর! তুমি আমার এত প্রতিভা আর আবেগানুভূতির গুরুভার না দিয় আমায় যদি একটু আত্মবিশ্বাস দান করতে!
আর কিছুদিন ধৈর্য ধরো। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ঠিক বলেছ বন্ধু, আমি আমার চারপাশের জনগণের জীবনযাত্রাপ্রণালী নিজের চোখে দেখে অনেক শান্তি পাচ্ছি মনে। নিজের সুখদুঃখ আর পাঁচজন মানুষের সুখদুঃখের সঙ্গে তুলনা করে মনটা অনেক হালকা হয়। তাই নির্জনতার মতো এত ভয়ঙ্কর বস্তু আর কিছু হতে পারে না। আমরা নির্জনে থাকলেই কল্পনায় আমরা আমাদের থেকে সুখী ও আদর্শ মানুষের ছবি ফুটিয়ে তুলি মনের উপর। নিজেদের অপূর্ণতার কথা মনে করে কষ্ট পাই মনে মনে।
কিন্তু আমরা যদি আর পাঁচজনের সঙ্গে আমাদের অবস্থার তুলনা করে দেখি তাহলে দেখব আমরা অন্যদের থেকে খুব একটা পিছিয়ে নেই। ফলে তার থেকে। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় আমাদের। মনে শান্তি ও স্থিরতা আসে।
নভেম্বর ১৩,
ধীরে ধীরে মনটা স্থির হয়ে আসছে আমার। বিচিত্র ধরনের মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রা দেখে আমারও কাজ করতে ইচ্ছা জাগছে। বিভিন্ন রঙের ছাপ পড়ছে আমার মনে। জনৈক কাউন্টের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। তাঁর মনটা বড় উদার, বড় সহানুভূতিশীল। তাঁর মতো লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়াটা সত্যি ভাগ্যের কথা। প্রথম আলাপের দিনই আমার প্রতি আগ্রহ জাগে তাঁর মনে। আমার সঙ্গে রোজ কথা বলতে ও গল্প করতে চান। মহানুভব ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার থেকে আনন্দের কথা আর কিছু হতে পারে না।
ডিসেম্বর ২৪,
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই হলো। রাষ্ট্রদূত ব্যক্তি আমার যথেষ্ট বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বুড়ি মেয়েমানুষের মতো প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনা নিয়ে বড় হৈ-চৈ করেন। যেসব লোক স্বভাবত অসন্তুষ্ট প্রকৃতির, কেউ তাদের কখনও সন্তুষ্ট করতে পারে না। আমার স্বভাব হচ্ছে সব কাজ তাড়াতাড়ি করা। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ফেলতে চাই আমি। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রদূত আমাকে বলেন আবার একবার ভালো করে দেখো। তাতে আমার মাথা গরম হয়ে যায়।
কিন্তু কাউন্টের বিশ্বাস আর ভালোবাসা আমার সব অভাব দূর করে দেয়। কাউন্ট তো একদিন আমায় স্পষ্ট বললেন, তিনি খুঁতখুঁতে স্বভাবের লোক, রাষ্ট্রদুত ভদ্রলোককে মোটে দেখতে পারেন না। এই ধরনের লোক সব কাজকে বেশি কঠিন করে তোলে। তবু আমাদের মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে। কোনও পথিকের সামনে পাহাড় পড়লে তার পার হতে হবেই।
আমাদের রাষ্ট্রদূত আবার আমার সঙ্গে কাউন্টের ভালো সম্পর্কটা ভালো চোখে দেখননি। তিনি এতে বিরক্ত বোধ করেন এবং সুযোগ পেলেই যখন-তখন আমার কাছে কাউন্টের নিন্দা করেন। আমি তার প্রতিবাদ করি আর তা করতে গিয়ে ব্যাপারটা আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে। গতকাল তার একটা কথা শুনে আমার প্রবল রাগ হয়ে যায়। তিনি বলেন কাউন্ট আর পাঁচজন সাহিত্যানুরাগী লোকের মতো অনেক বিষয় ভাসাভাসাভাবে জানেন। কিন্তু কোনও বিষয়ে গভীর ব্যুৎপতি বা পাণ্ডিত্য নেই। আমি তার প্রতিবাদ করে বলি কাউন্টের চরিত্র আর পাণ্ডিত্য দুটোই শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে আমাদের। তিনি নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম বজায় করেও অনেক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছেন। এই বলে আর কথার উত্তাপ না বাড়িয়ে উঠে পড়লাম।
আজকের আমার এই অবস্থার জন্য তোমরাই দায়ী। তোমরা আগে শুধু কাজের কথা বলতে। যে লোকটা আলুর চাষ করে, শহরের বাজারে রোজ আলু বেচতে যায় তার সঙ্গে আমার তফাৎ কোথায়? এই সব অবাঞ্ছিত অস্বস্তিকর লোকদের মাঝে বসে কাজ করা কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার! ওদের মনের ভাবধারা কত সংকীর্ণ! এক ভদ্রমহিলা সবার কাছে তার দেশের বাড়ি আর বংশ পরিচয়ের গর্ব করেন। তিনি সামান্য এক কেরাণির মেয়ে। এতে তাঁকে যে সবাই বোকা ভাবে তা তাঁর খেয়াল নেই।
তবে কে কি করছে তা দেখার আমার কোনো দরকার নেই। কারণ এ ছাড়া ভাববার অনেক কিছু আছে আমার। তা যে যা খুশি করুক, আমি আপনার নিজের কাজ করে যাব।
সবচেয়ে আমার দেশের সমাজ ব্যবস্থাটা খারাপ লাগে আমার। অনেকের মতো আমিও মনে করি সমাজে শ্ৰেণীবৈষম্য তুলে দেওয়া উচিত। তবে যতদিন আমরা আমার মনে সুখশান্তি ছিল ততদিন এ বিষয়ে কোনও কিছু ভাবিনি। সেদিস এক যুবতীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। মেয়েটি তার পিসির কাছে থাকে। পিসি ভদ্রমহিলা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। কিন্তু বর্তমানে গরিব হয়ে গেছেন। এখন শুধু বংশ ছাড়া বড়াই করার মতো কিছুই নেই। তার চেহারাটার মতো মন-মেজাজও খারাপ। তিনি সবাইকে ঘৃণার চোখে দেখেন। তিনি এক অফিসারকে বিয়ে করেন। কিন্তু ভদ্রলোক কিছুকাল আগে মারা যাওয়ায় এখন তিনি বিধবা। সম্পূর্ণ একা। এখন তাঁর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মনোভাবটাও অনমনীয় হয়ে উঠেছে।