সেপ্টেম্বর ৩,
আমাকে অবশ্যই চলে যেতে হবে। তুমি আমার প্রস্তাব সমর্থন করেছ জেনে খুশি হলাম। তোমাকে ধন্যবাদ। এক পক্ষকাল ধরে আমি এ বিষয়ে মনস্থির করার চেষ্টা করি। তাকে ছেড়ে যেতেই হবে। সে আবার শহরে গেছে তার কোনও এক বন্ধুর কাছে।
সেপ্টেম্বর ১০,
হায়, আজকের এই রাত্রির কথা যদি আমি তোমাকে চোখের জলের মাধ্যমে ব্যক্ত করতে পারতাম। আমার অন্তরের সব আবেগ যদি প্রকাশ করতে পারতাম তোমার কাছে। আজ রাতে আমি যে কোনও বাধা অতিক্রম করতে পারব। আজ এই নিস্তব্ধ নিঝুম রাত্রির শান্ত বাতাসে বসে নিজের বিক্ষুব্ধ অন্তরে শান্ত করার চেষ্টা করছি। সকালের জন্য প্রতীক্ষা করছি। সকাল হলেই ঘোড়া ঠিক করে রওনা হব।
লোত্তে এখন শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। আমার চলে যাওয়ার কথা সে কিছুই জানে না। সে জানে না আর আমাকে সে কোনওদিন দেখতে পাবে না। আজই বিকালে তার সঙ্গে আমার কত কথা হয়েছে। আলবার্তও তখন ছিল। আজই বিকালে ওদের বাগানে বাদাম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আমি যখন সূর্যাস্ত দেখছিলাম তখন আলবার্ত ছিল না। বলেছিল ওরা একটু পরে রাতের খাওয়া সেরে আসবে। সামনে নদীবিধৌত উপত্যকাভূমিকে সূর্যাস্তের রং ছড়িয়ে পড়তে দেখছিলাম এ দৃশ্য আমি কতদিন এর আগে লোত্তের সঙ্গে দেখেছি। কী আশ্চর্য! এ দৃশ্য আমি লোত্তের সঙ্গে আমার পরিচয় হবার আগেই দেখতে ভালোবাসতাম আর আমার এই প্রিয় দৃশ্যটা লোত্তেও ভালোবাসত।
এই বাদামগাছের তলায় যেদিন আমি প্রখম আসি সেদিন আমার কেমন যেন ভয় লাগছিল। তার নির্জনতা ও নিস্তব্ধতায় হারিয়ে যেতে যেতে আমার কেবলি মনে হচ্ছিল আমাকে যেন অনেক দুঃখে পেতে হবে। আমাকে অনেক অনেক দুঃখবেদনা সহ্য করতে হবে।
আমি সেই গোধূলিবেলায় সেই বাদামগাছের তলায় দাঁড়িয়ে লোত্তেকে ছেড়ে যাবার কথা ভাবছিলাম, তাকে ছেড়ে যাবার বেদনাটাকে আপন মনে লালন করেছিলাম। এমন সময় আলবার্ট আর লোত্তে এসে হাজির হলো। লোত্তের পাশে আলবার্ত বসল। আমি ওদের সামনে বসলাম। আমি এক জায়গায় চুপ করে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না।
হঠাৎ লোত্তে এক সময় বলল, চাঁদের আলোয় একা একা বেড়ালেই আমার মৃত প্রিয়জনদর কথা যেন মনে পড়ে জান? আমরা হয়ত দীর্ঘদিন বেঁচে থাকব, কিন্তু আবার। কি আমাদের দেখা হবে? আমরা কি চিনতে পারব পরস্পরকে?
আমি লোত্তের একটা হাত চোখের জলে ভিজিয়ে দিয়ে বললাম, আবার আমাদের দেখা হবে লোত্তে। দেখা হবে ইহলোকে ও পরলোকে।
বলতে পার উইলেম, লোত্তে কেন আমার চলে যাবার কিছু আগেই ওকথা জিজ্ঞাসা করল?
লোত্তে আবার তখন আমায় জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আমাদের মৃত প্রিয়জনরা কি আমাদের কথা জানতে পারে? আমাদের ভালোবাসা কি তারা অনুভব করতে পারে? কতদিন নির্জন সন্ধ্যায় আমার মনে হয়েছে আমার মার আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার চারপাশে। অশ্রুসজল চোখ তুলে আমাদের পানে তাকিয়ে কতবার মনে হয়েছে মা কি আমার স্বর্গ হতে দেখছেন আমি তাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করে চলেছি কিনা। মনে মনে বলি, তা তুমি দেখে যাও আমি আমার ভাই-বোনদের কত ভালোবাসি। কত। সম্প্রীতি ও ঐক্যের মধ্যে বাস করছি আমরা।
তার সে কণ্ঠস্বর কেমন করে চিঠিতে বোঝাব উইলেম। আলবার্থ একবার বলল, তুমি বড় আবেগে অভিভূত হয়ে পড়েছ লোত্তে। এখন এসব কথা থাক। কিন্তু লোত্তে বলল, সেই সন্ধ্যার কথা মনে ভাব একবার আলবার্ত, যেদিন বাবা বাইরে গিয়েছিলেন,
যেদিন আমার ভাই-বোনদের সব ঘুম পাড়িয়ে আমি বসে প্রার্থনা করেছিলাম আর তুমি। বই পড়ছিলে। আমি প্রার্থনা করছিলাম ঈশ্বরের কাছে, আমার মার আত্মার কাছে যাতে । আমি মার কথা রাখতে পারি, যাতে আমি তার মতো হতে পারি।
আমি তখন লোত্তেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ঈশ্বরের আশীর্বাদ ও তোমার মার আত্মার শুভেচ্ছা ঝরে পড়ুক তোমার উপর।
লোত্তে বলল, আমার মাকে তুমি দেখনি। দেখা হলে ভালো হতো। এটা সত্যিই দুঃখের কথা যে তাঁর মতো নারী অকালে চলে গেলেন পৃথিবী থেকে। কিন্তু তাতে কোনো দুঃখ ছিল না। তার একমাত্র দুঃখ ছিল শুধু তাঁর সন্তানদের জন্য। মৃত্যুকালে মা সব সন্তানদের ডাকলেন তাঁর কাছে। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। ছোটরা। তার অর্থ বুঝল না। তারপর আমার উপর তাদের দেখাশোনার ভার দিয়ে বললেন, বলো লোত্তে, এ ভার তুমি বহন করতে পারবে?
আমি আমার হাতখানি আশ্বাসের ভঙ্গিতে তাঁর হাতে তুলে দিলাম। তিনি তখন বললেন, জান এ প্রতিশ্রুতির অর্থ? মনে করবে আজ থেকে তুমিই হবে ওদের মা। ওদের সব কিছুর ভালো তোমার উপর। সেদিন বাবা বাড়িতে ছিলেন না। এ দুঃখ সহ্য করতে না পেরে তিনি বাইরে চলে গিয়েছিলেন। সেদিন সেই মুহূর্তে আলবার্ত তুমিও ছিলে সেখানে। তোমাকেও কাছে ডেকে আমাদের আশীর্বাদ করে দুজনকে যেন আমরা চিরদিন সুখে-শান্তিতে ঘর করি।
হঠাৎ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আলবার্ত লোত্তের ঘাড়ে চুম্বন করে আবেগের সঙ্গে বলল, আজও আমরা তাই আছি লোত্তে।
আলবার্ত সাধারণত সংযমী, আত্মস্থ। কিন্তু সেদিন প্রথম তাকে আবেগের বশীভূত হতে দেখলাম। লোত্তে উঠে পড়ল। আমি তার হাতখানি তখনও ধরে রেখেছিলাম। আমি বললাম, আবার আমাদের দেখা হবে। সে যে আকারেই থাক না কেন আমরা চিনে নেব পরস্পরকে।