আগস্ট ১৮,
ভাগ্যের কি পরিহাস। একদিন মানুষ যার থেকে কত আনন্দ পায়, পরে একদিন তাই দুঃখের কারণ হয়ে ওঠে তার কাছে।
আমি প্রকৃতিকে কত ভালোবাসতাম। প্রকৃতির যে সব বস্তু একদিন আমার এক চরম আনন্দে পরিপ্লাবিত করে তুলত আমার অন্তর, আজ তাদের দেখার সঙ্গে সঙ্গে বেদনায় পীড়িত হতে থাকে আমার সে অন্তর। আগে আমি যখন কোনও শান্ত গোধূলিবেলায় কোনও পাহাড়ের উপর বসে নদী ও প্রস্রবণবিধৌত উপত্যকাভূমির পানে তাকাতাম, কত অজানা পাখির সুর ঝরে পড়া ঘাসে ঢাকা প্রান্তরের উপর কত কীটপতঙ্গ উড়ে বেড়াত, তখন মুক্ত আকাশের তলে আমার চারদিকে পাহাড়ে উপত্যকায় বনে প্রান্তরে সৃষ্টির লীলাবৈচিত্র্য দেখে ও তার কথা ভাবতে ভারতে মুগ্ধ হয়ে যেতাম আমি। মনে হতো সৃষ্টির এই বিশাল ব্যাপক লীলাবৈচিত্রের পাশে আমি কত তুচ্ছ, কত নগণ্য। সঙ্গে সঙ্গে আমি এই বিশ্বসৃষ্টির বৈচিত্র্য থেকে পরম স্রস্টার চিন্তায় চলে যেতাম। তখন আমার চোখে দেখা প্রতিটি প্রাকৃতিক বস্তু আর প্রাণীর মধ্যে সেই পরম স্রষ্টার বিচিত্র প্রকাশকেই মূর্ত দেখতাম আমি। মনে হতো সেই এক অনন্ত পরম সত্তা বিচিত্ররূপে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে পাহাড়ে অরণ্যে প্রান্তরে, প্রতিটি প্রাণীর প্রাণচঞ্চলতায় ছড়িয়ে আছে। তাঁর সৃষ্টির আনন্দের একটা সামান্য অংশমাত্র আমাকেও বিভোর করে তুলছে।
আজ সেদিনের কথা ভাবতেও ভালো লাগছে। সেদিন যে অনির্বচনীয় আনন্দের। আবেগ অনুভব করতাম, আজ তার স্মৃতি আমার আত্মাকে দান করে এক মহান ভাবসমুন্নতি।
আজ আমাদের মনে আর সে অবস্থা নেই। আজ মনে হচ্ছে আমার মনের উপর যেন যুগান্তকারী এক যবনিকা তুলে দিয়েছে কে। অতীতে একদিন সৃষ্টির এক সর্বব্যাপী আনন্দকে পরিব্যাপ্ত দেখতাম সারা বিশ্ব জুড়ে, আজ সেখানে দেখি সাক্ষাৎ মৃত্যুর পর শূন্য বিশাল গহ্বর। আজ সর্বত্র সর্বক্ষণ বিশ্বসৃষ্টিতে ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস, ঝড় প্রভৃতি ধ্বংসের লীলাটাকেই বড় করে দেখি। মনে হয় এ জগতে সব কিছুই অনিত্য, সব কিছুই পরিবর্তনশীল। মনে হয় বিশ্বপ্রকৃতি এক সর্বধ্বংসী বিরাট মহাকাল আর চির উন্মুক্ত করাল বদন প্রতিটি মুহূর্তরূপী কালখণ্ডকে গ্রাস করে যাচ্ছে অবলীলাক্রমে।
আগস্ট ২১,
এক-একদিন সকালে উঠেই তাকে ধরার জন্য দুহাত বাড়িয়ে দিই। রাত্রিতে ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে স্বপ্নের মধ্যে আমার বিছানায় তার খোঁজ করি। স্বপ্নে দেখি কোনও নির্জন প্রান্তরে আমি তার পাশে বসে আছি। তার একটা হাত ধরে আমি চুম্বন করছি বার বার। জেগেই উঠেই হতাশ হই। চোখ দিয়ে জল পড়ে। আমার অন্তর বেদনায় মোচড় দিয়ে ওঠে। অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আরও কান্না পায়।
আগস্ট ২২,
আমার অবস্থা খুবই খারাপ উইলেম। এই সদাচঞ্চল অর্থহীন চঞ্চলতায় আমার সব উদ্যম ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। চুপ করে বসে থাকতে পারছি না আমি। আবার কোনও কাজও করতে পারি না। আমার আর কল্পনাশক্তি নেই, প্রাকৃতিক সৌন্দযে আমার কোনও আগ্রহ নেই। বই পড়তেও ভালো লাগে না। প্রতিদিন একটা আশা নিয়ে জেগে উঠি। কিন্তু সে আশা কোথায় বিলীন হয়ে যায়। আলবার্তকে দেখে হিংসা হয়। কতবার মনে হয়েছে আমি তোমাকে সেই চাকরিটার কথা লিখি। সেই মন্ত্রী আমাকে অনেক দিন ধরে একটা চাকরি করার কথা বলছিলেন। আমার অবস্থা এখন রূপকথার সেই ঘোড়টার মতো যে তার অবাধ মুক্তিতে হাঁপিয়ে উঠে আবার লাগাম কাঁধে নিয়ে খাটতে চেয়েছিল এবং মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল তাকে তার ফলে। আমি কি করব ঠিক তা বুঝে উঠতে পারছি না। আজ আমি যে পরিবর্তন চাইছি তা হয়ত আমার মনের এক গভীর অস্থিরতারই ফল। এই অস্থিরতা থেকে আমার মুক্তি নেই।
আগস্ট ২৮,
আমার মনের রোগ যদি কেউ দূর করতে পারে তো এরাই পারবে। আজ আমার জন্মদিন। আজ সকালে আলবার্তের কাছ থেকে একটা উপহার পাই। সেই উপহারের প্যাকেটে ছিল একটা গোলাপ আর দুখানা বই। লোত্তেকে আমি যখন প্রথম দেখি এই রঙের গোলাপ তার বুকের উপর পরেছিল।
দুখানা বই-এর মধ্যে একখানা ছিল আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত হোমারের ওয়েটস্লেন সংস্করণ। বইখানার কথা আমি একদিন বেড়াতে বেড়াতে বলেছিলাম আলবার্তকে। ওরা আমার মনের কথা বোঝে। তাকে কতখানি গুরুত্ব দেয়। জাঁকজমকপূর্ণ অন্য সব উপহারের থেকে এ উপহার আমার কাছে কত দামী। জীবনের কুঁড়ি কত ক্ষণভঙ্গুর উইলেম। কত কুঁড়ি অকালে ঝরে যায়, ম্লান হয়ে যায়। খুব অল্প কুঁড়িই ফুলে-ফলে পরিণত হয়। তবে কুঁড়িকে যেমন আমরা ভালোবাসি তেমনি পরিণত পাকা ফলকেও অবহেলা করা উচিত নয়। বিদায়, আজ এই পর্যন্ত থাক। এবারকার গ্রীষ্মটা ভালো লাগছে। আমি প্রায় দিন লোত্তেদের বাগানে লগা দিয়ে উঁচু ডাল থেকে পিয়ারা ফল পাড়ি আর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে লোত্তে তা কুড়িয়ে নেয়।
আগস্ট ৩০,
কী নির্বোধ, কী হতভাগ্য আমি! আমি কি নিজেকে প্রতারিত করছি না? এই অন্তহীন প্রেমাবেগের অর্থ কি? তাকে লাভ করার কথা ছাড়া আর কোনও কথা আমার মুখে আসে না। তার ছবি ছাড়া আর কোনও ছুবি ফুটে ওঠে না আমার মনে। জগতে যা কিছু দেখি লোত্তের সঙ্গে তাকে সম্পর্ক যুক্ত করে দেখি। যখন আমি লোত্তের পাশে দু-তিন ঘণ্টা ধরে বসে থাকি আর তার সুন্দর মুখ, থেকে ঝরে পড়া মিষ্টি কথা শুনি তখন মনে হয় যেন কোনও নরঘাতক আমার গলাটা চেপে ধরেছে। মনে হয় আমার কোনও অনুভব শক্তি নেই। মনে হয় আমি যেন আর ইহজগতে নেই। তারপর লোত্তে যদি দয়া করে তার হাতটা আমার চোখের জলে একবার ভিজিয়ে দিতে দেয় তাহলে আমার আর সেখানে না থেকে ছুটে পালিয়ে যাই। তখন আমি কোনও শূন্য বিশাল প্রান্তরে ঘুরে বেড়াই অথবা কোনও খাড়াই পাহাড়ে কষ্ট করে উঠতে থাকি। নিজেকে অকারণে ক্লান্ত করে বা কোনও কাঁপাঝোপে দেহটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে অদ্ভুত একটা আনন্দ পাই। অনেক সময় রাত্রে বাসায় ফিরি না। ক্লান্ত দেহে পথেই শুয়ে থাকি। মাথার উপর মুক্ত আকাশে যখন চাঁদ ভাসতে থাকে আমি তখন কোনও নির্জন বনভূমিতে কোনও গাছের তলায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। হায় উইলেম, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া আর আমার এ দুঃখের শেষ হবে না কিছুতে।