আলবার্ত আমার মুখপানে তাকিয়ে বলল, কথাটাকে অন্যভাবে নিও না। তুমি যে সব দৃষ্টান্তের উল্লেখ করলে তা ঠিক এখানে প্রযোজ্য নয়।
আমি বললাম, আমার খাড়া করা সব যুক্তি যে অসার, এ অভিযোগ এর আগেও শুনেছি। যাই হোক, কথাটাকে অন্যভাবে বলা যেতে পারে। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, আত্মহননেচ্ছু একটি মানুষের মনের প্রকৃত অবস্থাকে যথাযথভাবে ব্যক্ত করা।
আলবার্ত কিছু বলার আগেই আমি আরও বললাম, মানুষের প্রকৃতিটা এমন ভাবে গঠিত যে তার সহ্যের একটা সীমা আছে। সেই সীমা কোনোভাবে অতিক্রান্ত হলেই সে তা আর সহ্য করতে পারে না। তাহলে আসল কথা হচ্ছে মানুষের সহ্য শক্তির পরিসীমা যে কতখানি সবল বা দুর্বল তা নিয়ে এ ব্যাপারে তার কোনও বিচার চলবে না। দেখতে হবে পার্থিব-অপার্থিব যে সব দুঃখ সে পাচ্ছে তা সহ্য করার ক্ষমতা তার আছে কিনা। যদি না পারে তাহলে সে আত্মহত্যা করবেই। এক্ষেত্রে সে যদি সে দুঃখ সহ্য না পেরে আত্মহত্যা করে বসে তাহলে কোনওক্রমেই তাকে কাপুরুষ বলা চলবে না, যেমন কোনও দূষিত জ্বরের প্রকোপে কোনও কোনও লোক মারা গেলে তাকে কাপুরুষ বলা চলে না।
আলবার্ত বলে উঠল, তোমার কথা বৈপরীত্যমূলক।
আমি বললাম, যতটা ভাবছ তুমি ততটা নয়। যখন কোনও ভয়ঙ্কর রোগের আক্রমণ আমাদের দেহের সব শক্তিকে ক্ষয় করে ফেলে এবং সে ক্ষয় পূরণ হবার কোনও আশা থাকে না তখনই সে রোগকে আমরা মারাত্মক রোগ বলি। মানুষের মনও অনেক সময় এই ধরনের ভয়ঙ্করভাবে প্রবল ভাবাবেগের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং সে। আক্রমণের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা তার থাকে না। কোনও সুস্থ ও বলিষ্ঠ মানুষ যেমন কোনও অসুস্থ রুগ্ন ব্যক্তিতে সৎ পরামর্শ দিয়ে তার রোগ সারাতে পারে না তেমনি কোনও প্রকৃতিস্থ মানুষ তার ঠাণ্ডা মাথায় যুক্তি দিয়ে অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মারাত্মক ভাববেগকে প্রশমিত করতে পারে না কোনওভাবে।
আমি বুঝলাম এসব কথা বলে আলবার্তকে আমার মনে আসল কথাটা ঠিক বোঝানো যাবে না। আমি তাই এক বিশেষ ঘটনার কথা বললাম। কিছুদিন আগে স্থানীয় একটা জলাশয়ে একটি মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া যায়। আমি তার সূত্র ধরে বললাম, কোনও এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে একটি কুমারী মেয়ে বাস করত। বাড়িটি রক্ষণশীল বলে সে কোথাও যেতে পারত না। শুধু রবিবার একটু ভালো পোশাক পরে কিছুক্ষণ বেড়াতে পেত। তারও আবার তার সমবয়সী বান্ধবীদের সঙ্গে। অন্যদিক শুধু সারাদিনের মধ্যে দু-এক ঘণ্টা কোনও প্রতিবেশিনীর সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলা ছাড়া অন্য কোনো আমোদ-প্রমোদের সুযোগ পেত না। আর কোনও কোনও উৎসবের দিন। কোনও নাচের আসরে যোগদানের সুযোগ পেত। এইভাবে যখন মেয়েটির দিন কাটছিল তখন একটি লোকের সঙ্গে আলাপ হলো এবং সেই আলাপ-পরিচয় ক্রমে। ঘনিষ্ঠতা ও পরে ভালোবাসায় পরিণত হলো। সব কিছু ভুলে লোকটিকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলল মেয়েটি। সারা জগৎ ও জীবনের মধ্যে সেই লোকটিই হয়ে উঠল তার একমাত্র আশ্রয়স্থল। কিন্তু তাদের ভালোবাসাবাসি যখন আদর-চুম্বন ও প্রতিশ্রুতির বিভিন্ন স্তর পার হয়ে চরমে উঠেছিল তখনই হঠাৎ একদিন লোকটি মেয়েটিকে ত্যাগ করে চলে গেল। নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত জগৎ অন্ধকার হয়ে গেল মেয়েটির কাছে। তার মনে হলো, সমগ্র জগতের মধ্যে সে একেবারে একা। তার যে প্রেমাস্পদের সঙ্গে তার জীবনের অস্তিত্ব ছড়িয়ে পড়েছিল, সে প্রেমাস্পদ তাকে ছেড়ে দূরে চলে যেতেই তার অস্তিত্ব হয়ে গেল বিপন্ন। যে ভয়ঙ্কর বেদনায় প্রতিমুহূর্তে নিপীড়িত হচ্ছিল তার সমগ্র অন্তরাত্মা, সে বেদনার হাত হতে মুক্তি পাবার জন্য সে আত্মহত্যা করে বসল। এখন বলো আলবার্ত, মেয়েটির সেই জটিল মানসিক অবস্থা ও অন্তর্দ্বন্দ্ব কি দূরারোগ্য কোনও ব্যাধির মতোই ভয়ঙ্কর নয়?
অনেকে হয়ত বলতে পারে মেয়েটি কি বোকা? সে কিছুদিন নীরবে অপেক্ষা করলেই হয়ত তার বিক্ষুব্ধ চিত্তাবস্থা শান্ত হতো, হয়ত সে তার একজন প্রেমিক খুঁজে। পেত। কিন্তু আসলে কি এ কথার কোনও অর্থ হয়? কোনও লোক দূষিত জ্বরে মারা। গেলেও তাকে বলতে হয় সে আর কিছুদিন অপেক্ষা করলেই তার জ্বর সেরে যেত, সে তার ক্ষয় হয়ে যাওয়া জীবনীশক্তি ফিরে পেত। রক্তের সব তাপ ও উত্তালতা প্রশমিত হলে সে আবার বাঁচতে পারত।
তবু আলবার্ত আমার যুক্তি মানতে পারল না। সে বলল, আমি এমন এক সরলমনা মেয়ের কথা তুলে ধরেছি যার কোনও মানসিক শক্তি নেই। কোনও পরিণত বয়স্ক মানুষ যার যুক্তিবোধ প্রবল এবং মন শক্ত সে কখনও এ ধরনের কাজ করতে পারে না।
আমি তখন বললাম, দেখো, মানুষের যুক্তিবোধেরও একটা সীমা আছে। সেই যুক্তিবোধ দিয়ে সে তার চিত্তের সব ভাবাবেগকে শান্ত করে বা তার সব অন্তর্দ্বন্দ্বকে দমন করতে পারে না। যাই হোক, আজ আমি চলি। আসল কথা, এ জগতে সকলেই আপন আপন মনে চলে। কেউ কাউকে বুঝিয়ে তার স্বমতে আনতে পারে না।
এই বলে আমি আমার টুপিটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আলবার্তের ঘর থেকে।
আগস্ট ১৫,
ভালোবাসা ছাড়া মানুষকে এত আপন এত অত্যাবশ্যক আর কিছু করে তুলতে পারে না আমাদের কাছে। আমার মনে হলো লোত্তে আমাকে একেবারে ত্যাগ করতে পারবে না। লোত্তেদের বাড়ি আমি একদিন না গেলে চলে না। তার ভাইবোনেরা আমাকে রোজ যেতে বলে। আসার সময় বারবার বলে দেয় কাল সকালে এসো। যেন। আমি রোজ সকালে গিয়ে পাউরুটি কেটে তাদের সবাইকে ভাগ করে দিই। তারা আমার কাছে রূপকথার গল্প শুনতে চায়। অনেক সময় তাদের জন্য আমি গল্প বানিয়ে বলি।