তুমি হয়ত যুক্তি দেখিয়ে বলবে দীর্ঘ যন্ত্রণাভোগের থেকে অস্ত্রোপচার মেনে নেওয়া অনেক ভালো। দরকার বুঝলে আমাকেও তাই হয়ত করতে হবে।
আগস্ট ১০,
আমি যদি নির্বোধ না হতাম তাহলে এই অবস্থায় আমি প্রচুর সুখে-শান্তিতে দিন কাটাতে পারতাম। আনন্দোপভোগের এমন অনুকূল অবস্থা, এমন সুন্দর যোগাযোগ ঘটে ওঠে না কোনও মানুষের ভাগ্যে। একটি গোটা পরিবারের সকলের ভালোবাসা পাওয়া কি সহজ কথা? পরিবারের বৃদ্ধ কর্তা আমাকে আপন সন্তানের মতো ভালোবাসেন। পরিবারের ছেলেমেয়েরা সবাই আমাকে তাদের বাবার মতোই ভালোবাসে। লোত্তে নিজেও আমাকে সহাভূতির চোখে দেখে। আলবার্ত আমাকে পর বন্ধুর মতো ভালবাসে। সে আজ পর্যন্ত একটি মুহূর্তের জন্যও আমাকে দেখে বিন্দুমাত্র বিরক্ত হয়নি। আমার সুখে কখনও ব্যাঘাত ঘটায়নি সে। সবচেয়ে আমার ভালো লাগে আলবার্ট আর আমি দুজনে যখন পথ চলি আর আলবার্ট আমাকে শোনায় লোত্তের গুণের কথা তখন সত্যিই আমার চোখে জল আসে। আলবার্ত বলে, লোত্তের মা মৃত্যুকালে লোত্তের উপর সংসারের সব ভার দিয়ে যায়। তারপর থেকেই লোত্তে ঘোর সংসারী হয়ে ওঠে। সব ছেলেমেয়েরা তাকে মায়ের মতো জ্ঞান করতে থাকে। অথচ ঘর-সংসারের এত সব কাজকর্ম করেও তার বিরক্তি নেই মুখে। সব সময় হাসি লেগে আছে সে মুখে। লোত্তের গুণের এই সব কথা শুনতে শুনতে আমার চোখে জল আসত। আলবার্ট কিছুদিনের মধ্যেই কাউন্টের কাছ থেকে ডাকযোগে কিছু টাকা পাবে। তার মতো পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান যুবক খুব কমই আছে।
আগস্ট ১২,
আলবার্ত সত্যিই বড় চমৎকার লোক। গতকাল অদ্ভুত একটি ঘটনা ঘটে। গতকাল তার বাড়িতে আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম তার সঙ্গে। আমি কিছুদিনের জন্য পাহাড় অঞ্চলে বেড়াতে যাচ্ছি। তার বাড়িতে গিয়ে আমি তার দুটো পিস্তল দেখে সে-দুটো চেয়ে বসি। বলি, ও দুটো আমায় ধার দাও। কিছুদিনের জন্য। পথে কাজে লাগতে পারে।
তখন আলবার্ত তার এই পিস্তলের গল্প বলতে থাকে। সে বলে, একবার সে তাদের গায়ের বাড়িতে তার কোনও এক বন্ধুর সঙ্গে তিন মাস কাল থাকে। এই পিস্তল দুটা তখন তার কাছেই ছিল। কিন্তু কোনও কাজে লাগেনি। কোনও প্রয়োজন হয়নি ওদের। কোনও এক বৃষ্টির দিনে হঠাৎ আমার মনে হয় আজ রাতে হয়ত দরকার হতে পারে। হয়তো কোনও চোর-ডাকাত আসতে পারে। এই ভেবে একজন চাকরকে। পিস্তল পরিষ্কার করতে বলি। সে পরিষ্কার করে গুলি ভরে ঝিদের ঠাট্টা করে ভয় দেখাতে থাকে। হঠাৎ একটি গুলি ফস্কে যায় আর তা একটি মেয়ের হাতে লাগে। সার্জন ডেকে তার চিকিৎসার সব খরচ দিতে হয় আমায়। সেই থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি ওদের আমি ব্যবহার করব না। সেই থেকে ওরা পড়ে আছে এইভাবে। জানবে মানুষ সব বিপদ হতে আত্মরক্ষার সব ব্যবস্থা করে রাখতে পারে না। বিপদ যখন আসার আসবেই। তার কথা বলা শেষ হলে আমি একটা পিস্তল নাড়াচাড়া করতে করতে তার নলটা আমার মাথার কপালের কাছে ঠেকিয়ে ধরলাম। আলবার্ত আমার হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে বলল, এর মানে কি?
আমি বললাম, ওর ভিতরে গুলি নেই।
আলবার্ত বলল, তা হলেও এর কোনও মানে হয় না। মানুষ কিভাবে যে নিজেকে গুলি করে মারে তা আমি বুঝতে পারি না।
আমি বললাম, কোনও একটা কাজ ঘটলেই তোমরা সবাই ভালোমন্দ নাম দিয়ে বিচার করতে থাকো। কিন্তু কোন অন্তর্নিহিত প্রেরণার বশে মানুষটা সে কাজ করতে বাধ্য হলো তা তোমরা কেউ ভেবে দেখো না। সেখানে এত তাড়াতাড়ি বিচারের রায় দিতে হবে।
আলবার্ত বলল, কতকগুলো কাজ আছে বিশ্বাস করো, সত্যিই খারাপ, তার কারণ যাই থাক, যে কোনও দিক দিয়ে তা বিচার করা যাক।
আমি বললাম, তা হয়ত ঠিক বন্ধু, কিন্তু সেখানেও কথা আছে। মনে করো, চুরি করা পাপ কিন্তু যে মানুষ নিজেকে বা তার পরিবারকে অনশন আর মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য চুরি করে, সে ঘৃণার যোগ্য না সহাভূতির পাত্র? কেউ যদি তার অবিশ্বাসী স্ত্রী ও তার অবৈধ প্রণয়ীকে রাগের বশে হত্যা করে তাহলে সে তাকে অপমান করবে? এমনকি আইনও অনেক সময় এই সব ঘটনার শাস্তিদানে বিরত থাকে।
আলবার্ত বলল, ওটা অন্য ব্যাপার। যে মানুষ আবেগের দ্বারা তাড়িত হয়ে কোনো কাজ করে তার কোনও যুক্তিবোধ বা চিন্তাশক্তি থাকে না। তার আচরণ তখন পাগল অথবা মাতাল লোকের আচরণের পর্যায়ে গিয়ে পড়ে।
আমি চিৎকার করে বললাম, তোমরা যুক্তিবাদীরা আবেগপ্রবণ লোকদের মাতাল ও পাগল বলে ঘৃণী করো। ঠাণ্ডা মাথায় এসব কথা বলা সহজ। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিও কারণ সে অবস্থায় তোমরা পড়নি। তবে দুনিয়ায় যারা বড় কাজ করছে বা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে তাদের লোকে পাগল অথবা মাতাল বলে বদনাম দিয়ে এসেছে।
আলবার্ত বলল, তুমি আবেগের বশে বাড়াবাড়ি করছ। আত্মহত্যার কথা আলোচনা হচ্ছিল। আত্মহত্যাটাকে কোনও মহৎ কাজের সঙ্গে তুলনা করা চলবে না। তুমি এইখানেই ভুল করছিলে। আসলে আত্মহত্যা কাজটা একটা দুর্বলতা ছাড়া কিছুই নয়। দুঃখের জীবন সহ্য করার থেকে মৃত্যুবরণ করা সহজ বলেই লোকে আত্মহত্যা করে থাকে।
আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল। এক উত্তপ্ত আবেগে অন্তর আমার পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তবু কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, তুমি এটাকে দুর্বলতা বলছ? যখন মানুষ প্রবল অত্যাচারে উৎপীড়িত হয়, যখন তার চোখের সামনে তার ঘরবাড়ি ভস্মীভূত হয়, তখন যদি সে এক নিরস্ত্র অবস্থায় আধ ডজন সশস্ত্র লোকের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমে পড়ে, তখন তার সেই মরিয়া ভাবটাকে দুবর্লতা বলবে?