আমি তিন-তিনবার লোত্তের একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করি আর তিনবারই ব্যর্থ হই। তাতে আমার নিজের উপর রাগ হয়। অথচ কিছুদিন আগে আমি তা ভালোভাবেই পেরেছিলাম।
জুলাই ২৬,
আমি প্রায়ই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি এত ঘন ঘন তার কাছে যাব না। যাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু হায়, এ প্রতিজ্ঞা আমি রাখতে পারি না। প্রতিদিনই আমি প্রতিজ্ঞা করি আর প্রতিদিনই আমি সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করি। লোত্তের কাছে যাওয়ার প্রলোভন আমি জয় করে পারি না। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে যাবার জন্য কোনও না কোনও যুক্তি খাড়া করি এবং কখন এক সময় তার কাছে গিয়ে পড়ি। কোনও কোনওদিন অবশ্য লোত্তের কাছ থেকে আসার সময় সে আমাকে বলে, কাল তুমি আসবে না? কি বলছ? এই ধরনের কথা শুনে কেউ কখনও ঠিক থাকতে পারে? না গিয়ে থাকতে পারে? অথবা যেদিন লোত্তে এসব বলে না বা যাবার জন্য কোনও অনুরোধ করে না সেদিনও দিনটা উজ্জ্বল হলেই আমি আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে তাদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছই। আমার ঠাকুরমা ছেলেবেলায় এক চুম্বক পাহাড়ের গল্প করতেন। সেই অদ্ভুত পাহাড়টা দূর থেকে জাহাজের লোহার পেরেকগুলোকে দুর্বার বেগে আকর্ষণ করত। জাহাজগুলোও সেই আকর্ষণে পাহাড়ে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে খান খান হয়ে যেত। আমারও আজ হয়ত সেই অবস্থা।
জুলাই ৩০,
আলবার্ত এসে গেছে, আমাকে এবার যেতে হবে। যদি মানুষ হিসাবে আলবার্তের মহত্ত্বকে শ্রদ্ধা করি আমি তথাপি আমার সামনে আমার প্রেমাস্পদের কাছে তার উপস্থিতিকে সহ্য করতে পারি না আমি কিছুতেই। আমারই সামনে সে আমার প্রেমের বস্তুকে করায়ত্ত করে ফেলবে এটা ভাবতেও পারি না আমি। অথচ ও তার ভাবী স্বামী। কথাবার্তা সব হয়ে গেছে। আর পাত্র হিসাবেও সব দিক থেকে যোগ্য আলবার্ত। তার গুণের জন্য আমিও তাকে পছন্দ না করে পারি না। কিন্তু তাহলেও আলবার্তকে যদি আমার সামনে অভ্যর্থনা জানাত লোত্তে তাহলে আমি তা সহ্য করতে পারতাম না। আমার অন্তর বিদীর্ণ হয়ে যেত। আলবার্তের আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধ বড় তীক্ষ্ণ। আমার সামনে সে কোনওদিন লোত্তেকে চুম্বন করেনি। লোত্তের প্রতি তার সংযত ও শোভন আচরণ দেখে তাকে আমি ভালো না বেসে পারি না। তাছাড়া আমার প্রতিও সে বন্ধুত্বের ভাব পোষণ করে। অবশ্য বলতে পার লোত্তে আমাকে কিছুটা পছন্দ করে বলেই হয়ত সে আমাকে ভালোবাসে। অনেক সময় মেয়েরা সম্ভব হলে তাদের দুজন গুণগ্রাহী বা প্রেমিককে পুষে রাখে, কারণ তাতে তাদেরই লাভ।
কিন্তু আলবার্তকে আমি শ্রদ্ধা না করে পারি না। তার শান্ত স্বভাব ও আচার আচরণ আমার চঞ্চল স্বভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত। মনের চঞ্চলতা আমি কখনও দমন করে রাখতে পারি না। সে কখনও রাগে না বা মাথা গরম করে না, যেটা তুমি জান আমি মোটেই পছন্দ করি না।
আলবার্ত আমাকে বিজ্ঞ মানুষ বলে জানে। লোত্তের সঙ্গে মেলামেশা করে আমি আনন্দ পাই তা সে জানে। তুমি কিছু মনে করে না। অবশ্য আমার অসাক্ষাতে সে লোত্তেকে কিছু বলে কিনা তা জানি না।
সে যাই হোক, লোত্তের সাহচর্যে আনন্দ লাভের পথ বন্ধ হয়ে গেল। তার প্রতি আমার এই আসক্তির প্রবণতা কি নির্বুদ্ধিতা? যাই হোক, যাই বলল, সে সুখে থাকত জানি। আলবার্তের আসার আগেই এমন ঘটবে আমি জানতাম। আলবার্ত যখন এসে গেছে তখন লোত্তের উপর আর আমার কোনও আসক্তি নেই।
আমার নিজের অসহায়তা ও হতভাগ্য অবস্থায় আমি নিজেই তা-হুঁতাশ করি। আমি নিজেকেই উপহাস করি। যারা আমাকে এ অবস্থায় ধৈর্য ধরতে বলে অথবা মুখ। বুঝে সব নীরবে সহ্য করে যেতে বলে তাদেরও উপহাস করি আমি। আমি আজকাল সময় কাটাবার জন্য শূন্য মনে বনে বনে ঘুরে বেড়াই। বেড়াতে-বেড়াতে এক সময় লোত্তের বাড়িতে পৌঁছে যাই। দেখি তাদের বাগানে আলবার্ত তার পাশে রয়েছে। তাদের কাছে আমি অনেক সময় কোনও কিছু করার বা বলার না পেয়ে ভাঁড়ের মতো আজেবাজে কথা বলি এবং অভিনয় করি। তা দেখে লোত্তে নিজেই অস্বস্তি বোধ করে।
একদিন সে স্পষ্টই বলে আমায়, গতকালকার মতো ওরকম অভিনয় আর তুমি দেখিও না। আলবার্ত লোত্তের কাছ থেকে অন্য কোথাও না যাওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করি। লোত্তেকে একা পেয়ে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচি।
আগস্ট ৮,
কিছু মনে করো না উইলেম, যারা আমায় ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দেয়, আমি তাদের দলে তোমাকে ধরিনি। তুমি যে এই ধরনের উপদেশ দেবে তা আমি ভাবতে পারিনি। জগতে ও জীবনে কখনও মানুষ একই সঙ্গে দুটো পথে চলতে পারে না। দুটো পথের মধ্যে একটাকে তাকে বেছে নিতেই হয়, কারণ একটা পথ ধরতে গেলেই অনেক আবেগ বা অনুভূতির স্তর অতিক্রম করতে হয়। তাই তোমার সব যুক্তি ও পরামর্শ ভালোভাবে বিবেচনা করে দেখার পরও আমি সেইমতো চলতে না পারি তাহলে কিছু মনে করো না যেন।
হয় লোত্তেকে পাবার আশা আছে আবার হয়ত তা নেই। যদি আশা থাকে তাহলে তাকে লাভ করার জন্য। আমার চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য আমাকে চেষ্টা করে যেতে হবে শেষ পর্যন্ত। আর যদি তা না থাকে তাহলে এই অস্বস্তিকর আবেগের হাত থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নিতে হবে। তা না হলে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাব আমি।
কিন্তু যন্ত্রণাকাতর কোনও মানুষকে কি তুমি যন্ত্রণার হাত হতে মুক্তি পাবার জন্য ছুরিকাঘাতে আত্মহত্যা করার পরামর্শ দেবে? যে রোগ থেকে এ যন্ত্রণার উদ্ভব হয় সে রোগ করি তার সব সাহস ও শক্তিও নষ্ট করে দেয় না?