জুলাই ১০,
লোত্তের পাল্লায় পড়ে আমি এক বৃদ্ধ মহিলার বাড়িতে মাঝে-মাঝে যাই। বৃদ্ধা অনেকদিন ধরে ভুগছেন। এখন তার অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। লোত্তেকে তিনি স্নেহ করতেন। একদিন লোত্তের সামনে বৃদ্ধা এক স্বীকারোক্তি করলেন। বড় অদ্ভুত লাগল সে কথা। তাঁর স্বামী বরাবর অতিশয় কৃপণ প্রকৃতির ছিল। তার অবস্থা যখন খারাপ ছিল তখন সপ্তায় যা সংসার খরচ দিত, তার অবস্থা ভালো হলে অর্থাৎ কাজ-কারবারের উন্নতি হলেও সেই খরচই দিত। কোনও মতেই সে তার থেকে বেশি দিতে রাজি হয়নি। অথচ আগের থেকে সংসারের বহর বেড়ে যাওয়ায় খরচপত্রও বেড়ে যায় প্রচুর। তখন অগত্যা বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাকে স্বামীর ক্যাশবাক্স থেকে প্রতিমাসে চুরি করতে হতো। এছাড়া কোনও উপায় ছিল না তার। মৃত্যুকালে একথা প্রকাশ না করে শান্তি পাচ্ছেন না তিনি মনে। তাই স্বীকারোক্তি করলেন।
জুলাই ১৩,
না, নিজেকে আমি ভোলাচ্ছি না, আমি সত্যিই তার চোখে স্পষ্ট দেখেছি আমার প্রতি এক অকৃত্রিম মমতাকে মূর্ত হয়ে উঠতে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি আমার নিজের অন্তরকে বিশ্বাস করি। সে আমাকে সত্যিই–হ্যায়, সে আমাকে ভালোবাসে। একথাটা মনে ভাবতেই নিজের কাছে নিজেকে মূল্যবান মনে হতে লাগল আমারও। একথা তোমাকে না বলে পারলাম না। কারণ তোমার বোধ শক্তি আছে, হৃদয় আছে।
আমি কিন্তু জানি না সে আমাকে ঠিক ভালোবাসে কি না। বুঝতে পারছি না আমার এই ধারণা দুঃসাহসের নামান্তর কি না। তবে লোত্তে যখন ভাবী স্বামীর কথা বলে তখন বেশ বোঝা যায় সে তাকে ভালোবাসে। সে ভালোবাসার সঙ্গে মিশিয়ে আছে অন্তরের উত্তাপ। তখন আমার খুব খারাপ লাগে। নিজেকে ছোট মনে হয়। বঞ্চিত মনে হয়।
জুলাই ১৬,
এক জায়গায় বসে কথা বলতে বলতে যখন আমার হাত বা হাতের আঙুল লোত্তের হাতে কোনওভাবে ঠেকে যায় তখন কেমন যেন একটা প্রবল আলোড়ন শুরু হয়ে যায় আমার সারা দেহ-মনে। আমার প্রতটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শিরায় শিরায় রক্ত উত্তাল হয়ে ওঠে। এক রহস্যময় অদম্য শক্তি তার দিকে অর্থাৎ তার আরও কাছে টেনে নিয়ে যায় আমায়। তার নিষ্পাপ সরলতা আমার বড় ভালো লাগে। তার মন কত পবিত্র। সে কথা বলতে বলতে আবেগের ঝোঁকে অনেক সময় আমার হাতে হাত দিয়ে বসে। কিন্তু বুঝতে পরে না তার প্রতিক্রিয়া কত ভীষণ আমার পক্ষে।
তবে আমার কাছে সে সত্যিই এক পবিত্র দেবদূতের মতো। সে আমার কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমারও দেহগত সকল কামনা-বাসনারা নীরব নিরুচ্চার হয়ে যায়। আমার সকল দুঃখ-বেদনা স্তব্ধ হয়ে যায়। সে যখন পিয়ানো বাজিয়ে গান গায়, তার গানের মিষ্টি সুরে আমারও হৃদয়ের যতসব অন্ধকার, যতসব ভ্রান্তি কোথায় যেন মুহূর্তে উবে যায়। নিজেকে তখন বড় হালকা মনে হয়। খুব সহজ মনে হয়।
জুলাই ১৮,
বলো উইলেম, প্রেম ছাড়া জীবনের কি অর্থ হয়? ম্যাজিক লণ্ঠনের মধ্যে বাতি না থাকলে তার যেমন অবস্থা হয়, প্রেম ছাড়া জীবনেও হয় সেই অবস্থা। অথচ ম্যাজিক লণ্ঠনের প্রভাবে সাদা পর্দার উপর যে সব রঙিন ছবি ফুটে ওঠে সেগুলো মিথ্যা অর্থহীন হলেও আমরা তা শিশুর মতো অবাক বিস্ময়ে দেখি। বিশেষ কারণে আটকে পড়ায় আজ আমি লোত্তেকে দেখতে যেতে পারিনি। আমার বালক ভৃত্যটাকে তার কাছে পাঠাই। ছেলেটার পথপানে তাকিয়ে অধীর অপেক্ষা করতে থাকি আমি। সে যখন ফিরে আসে তখন লজ্জায় বিরত না হলে তাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করতাম আমি।
শুনেছি বেলোগনা পাথর নামে এক ধরনের পাথর আছে যা সূর্যের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তুলে ধরে থাকলে তা সূর্যরশ্মিকে আকর্ষণ করে ধরে রাখে তার মধ্যে। আমরা বালক ভৃত্যটাকে সেই পাথরের মতো মনে হলো আমার। আমার কেবলি মনে হতে লাগল ও লোত্তের কাছে গেলে লোত্তে ওকে দেখেছে, কথা বলেছে। তার মধুর দৃষ্টির স্বর্গীয় দ্যুতি ঝরে পড়েছে ওর সারা দেহে এবং তা এখনও লেগে আছে। সে দ্যুতির স্পর্শে পবিত্র হয়ে আছে ওর সারা দেহ। সেই মুহূর্তে অসংখ্য মুদ্রার বিনিময়েও ছেলেটাকে ছাড়তে পারতাম না আমি। বলো উইলেম, সেই সময় আমি ছেলেটাকে দেখে ও তার সাহচর্য উপভোগ করে যে আনন্দ পেয়েছিলাম তা কি মিথ্যা? তা কি অর্থহীন?
জুলাই ১৯,
আজ আমি তাকে দেখতে যাচ্ছি। সকালে উঠে উজ্জ্বল সূর্যের সামনে তাকিয়ে চিৎকার করে কথাটা বলতে ইচ্ছা করছে আমার। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। সারা দিনের মধ্যে আর কিছু করার ইচ্ছা নেই আমার।
জুলাই ২০,
তুমি আমাকে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিদেশে যেতে বলেছ। কিন্তু তোমার পরামর্শ মানতে পারলাম না। আমি নিয়ম-শৃংখলার কথা কিছু বুঝি না। আমরা সবাই জানি লোকটা ভালো নয়। তুমি লিখেছ আমার মা চান আমি কোনও একটা কাজে নিযুক্ত হয়ে পড়ি। কথাটা শুনে হাসি পেল আমার। আমি কি কাজে নিযুক্ত হইনি? এটা কি কাজ নয়? বাইরের কাজটাই কি সব? যে মানুষ নিজের কোনও না কোনও উচ্চাশা বা লাভ করার বাসনা ত্যাগ করে শুধু পরের জন্য খেটে খেটে জীবনপাত করে চলে সে বোকা।
জুলাই ২৪,
তুমি আমাকে ছবি আঁকার কথা প্রায়ই বলো। এ বিষয়ে আমি স্পষ্ট স্বীকার করতে চাই যে আমি একদিন কিছুই আঁকতে পারিনি।
প্রকৃতির কাছে গিয়ে আমি আনন্দ পেতাম। প্রকৃতির ঘাস-পাথর প্রভৃতি প্রতিটি বস্তুকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু আমার পর্যবেক্ষণ শক্তি ভালো না থাকায় আমি আমার চোখের দেখা সেই সব প্রকৃতির বস্তুকে ঠিকমতো ফুটিয়ে তুলতে পারিনি অথবা তাদের সম্বন্ধে আমার মনের অনুভূত সত্যকেও প্রকাশ করতে পারিনি। ছবি আঁকার সময় আমার মনশ্চক্ষুর সামনে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায়। আমার তখন মনে হয়। আমার হাতে একতাল কাদামাটি থাকলে আমি তাই নিয়ে কিছু একটা গড়তে পারতাম।