আমি লক্ষ করলাম, প্যাস্টর আমাদের কথা মন দিয়ে শুনছে। আমি তাকে লক্ষ করে বললাম, যাজকরা বক্তৃতামঞ্চ থেকে মানুষের অনেক দোষের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেন। কিন্তু তাঁরা অহেতুক বিষাদ বা বদমেজাজের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেন না।
প্যাস্টর বলল, গ্রাম্য চাষিদের দোষ নেই। এ দোষ যদি থাকে তাহলে তা শহুরে লোকদেরই আছে এবং শহরের যাজকরাই তার বিরুদ্ধে প্রচারকার্য চালাবে। তবে মাঝে মাঝে এ বিষয়ে কিছু উপদেশ দিলে অবশ্যই আমাদের স্ত্রীরা উপকৃত হবে।
প্যাস্টরের কথায় সবাই হেসে উঠল। কিন্তু ফ্রেদারিকের প্রেমিক যুবকটি বলল, বিষাদ বা বদমেজাজ একট দোষ একথা আমার কাছে অত্যুক্তি বলে মনে হচ্ছে।
তার উত্তর আমি বললাম, মোটেই না। যার দ্বারা আমরা আমাদের নিজেদের ও অপরের আনন্দকে নষ্ট করি তার অন্য নাম কি হতে পারে বলুন? আমরা কাউকে সুখী না করতে পারি, তবে আনন্দ না দিতে পারি কিন্তু তার ছোট্ট সুখ বা আনন্দটুকুকে কেড়ে নেবে কোন অধিকারে বলতে পারেন? আচ্ছা আপনি কি এমন কোনও বিষাদগ্রস্ত বা বদমেজাজী লোকের নাম করতে পারেন যিনি তাঁর অন্তরের বিষাদময়তাকে অন্তরের মধ্যেই চেপে রেখে দিতে পারেন? অর্থাৎ যিনি তাঁর নিজের দুঃখানুভূতির কোনওরূপ অভিব্যক্তি না ঘটিয়ে অন্য কারও সুখ বা আনন্দের অনুভূতিকে নষ্ট করেন না? এ বিষাদ কি আমাদের নিজেদের প্রতিই এক বিরাগময় অর্থহীন আত্মভিমানের দ্বারা লালিত এক আত্মবিরূপতা নয় যা মানবচরিত্রের একটি দোষ ছাড়া কিছুই নয়?
লোত্তে আমার পানে তাকিয়ে হাসল। ফ্রেদারিকের চোখে এক ফোঁটা জল দেখে আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম, যারা অপরের অন্তরের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দেকে কেড়ে নেয় তাদের ধিক, শত ধিক। যদি কারও একটি মুহূর্তের আনন্দ নষ্ট হয় তাহলে তার সে ক্ষতি পৃথিবীর কোনও দান কোনও সময় পূরণ করতে পারে না কখনও।
আমরা যেন প্রতিদিন এই কথাই সকলকে বলি যে যদি তোমার অপরের উপর প্রভাব বিস্তার করার কোনো ক্ষমতা থাকে তাহলে তার দ্বারা অপরকে আনন্দ দান করো বা সুখী করার চেষ্টা করো। অপরের অন্তরখানি কোনও কারণে দুঃখের দ্বারা পীড়িত হলে সে দুঃখের উপর কি কোনো শান্তির প্রলেপ লাগিয়ে দিতে পার?
হঠাৎ একটা কথা আমার মনে পড়ে গেল। একটি লোক তার স্ত্রীকে ভালোবাসত না। এইভাবে তাদের যৌবন কেটে যায়। কিন্তু মেয়েটির মৃত্যুকালে তার স্লান মুখ আর সকরুণ অবস্থা লোকটার মনে করুণা জাগায়। তার হঠাৎ মনে হলো তার স্ত্রীকে বাঁচাবার জন্য সে তার সব কিছু দিয়ে দিতে পারে।
আমাদেরও উচিত এইভাবে প্রতিটি ম্লান মুখে হাসি ফোঁটাবার জন্য তাদের নিরানন্দ অন্তরে এক ফোঁটা আনন্দ সঞ্চারের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করা।
আবেগের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার চোখে জল এসেছিল। আমি রুমালে চোখ ঢেকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। যাবার সময় লোত্তে আমায় ডাকতে আমার হুঁশ হলো। পথে লোত্তে বলল, তুমি বড় ভাবপ্রবণ। সব কিছুতেই এতখানি গুরুত্ব আরোপ করা উচিত নয়। এতে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। আমি তখন মনে মনে বললাম, তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্যই আমি বাঁচব হে কন্যা।
জুলাই ৬,
হে প্রায়ই তার মুমূর্ষ বন্ধু প্যাস্টরকে দেখতে যায়। আর একদিন দুই বোন মেরিয়ানে ও আমেলিয়াকে সঙ্গে করে গিয়েছিল। পথে আমি ওদের সঙ্গী হয়েছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে চলার পর পথে একটা ঝর্না পড়ল। আমরা সবাই সেই ঝর্নার ধারে গিয়ে বসলাম। স্বচ্ছশীতল জলের ধারা দেখে লোত্তের বোনরাও আনন্দিত হলো। ওদের সঙ্গে একটা গ্লাস ছিল। ঝর্নার জল পান করার জন্য মেরিয়ানে সেই গ্লাসটা বার করতেই ছোট্ট আমেলিয়া বলল, লোত্তে, তুমি আগে খাও। তার কচি মুখের আধো আধো কথা শুনতে আমার ভারি ভালো লাগল। আর আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে কোলে তুলে নিয়ে তার মুখে ও গালে আন্তরিকতার সাথে চুম্বন করলাম। মেয়েটি তাতেই কেঁদে উঠল।
লোত্তে তখন আমাকে বলল, তুমি অন্যায় করেছ। এই বলে আমেলিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে ঝর্নার ধারে নিয়ে গিয়ে বলল, এই জলে মুখটা ধুরে নাও নিজের হাতে। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আর আমেলিয়া তার কচি হাত দিয়ে জল তুলে তার গাল, মুখ সব ধুতে লাগল। লোত্তে বলল, এবার হয়েছে। তবু সে ধুয়ে যেতে লাগল। আমি তার মুখ চুম্বন করে যে কলুষ ও অপবিত্রতায় ভরে দিয়েছি সে মুখ তার যেন শেষ নেই।
এই ঘটনায় আমি দুঃখ পেয়েছিলাম। কথাটা কোন একজন লোককে বলি। সে বলে, লোত্তে সত্যিই খুব অন্যায় করেছে। এটা কুসংস্কার, বাচ্চা মেয়ের মুখ, বাইরের কোন লোক চুম্বন করলে সে মুখে দাড়ি গজায় বা মুখ অপবিত্র হয় এটা অন্ধ কুসংস্কারমাত্র।
আমার মনে হলো আমরাও অনেক সময় শিশুর মতো ভ্রান্তি বা মায়ার ছলনায় মুগ্ধ হয়ে ভুল করে বসি।
জুলাই ৮,
হায়, কি ধরনের শিশু আমরা। সামান্য দুটো চোখের দৃষ্টির জন্য কত লোভ আমাদের। আমরা সেদিন গাড়িতে করে ওয়ালহেম গাঁয়ে ফিরলাম। গাড়িতে কয়েকজন মহিলা ও দুটি যুবক ছিল। আর ছিলাম আমি আর লোত্তে। সব সময় সারা পথ ধরে শুধু লোত্তের পানে তাকিয়েছিলাম। শুধু লক্ষ করেছিলাম সে কোন দিক কখন তাকায়। কিন্তু একবারও সে আমার পানে তাকাল না। তার দৃষ্টি কেবল এদিকে-সেদিকে ঘোরাঘুরি করছিল। আমার কেবলি মনে হচ্ছিল তার কালো চোখের চতুর দৃষ্টিতে আমি এক নির্বোধ মাত্র। তার বাড়ির দরজার কাছে গাড়ি থেকে নেমে গেল লোত্তে। সে আমার মুখপানে একবার নীরবে তাকাল মনে হলো। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না সে আমাকেই দেখল না অন্য কাউকে দেখল।