বেরোতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, নির্দিষ্ট সময়ের একটু পরেই বেরিয়ে পড়লাম তাড়াহুড়ো করে।
কোনও একটি বাড়ির একতলার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম আমরা। ঘরটির আসবাবপত্র সাধারণ ধরনের হলেও ঘরখানি প্রশস্ত। ঘরের মধ্যে লোক ছিল অনেক। ঘরের মাঝখানে একটি পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইবে।
আমি পিয়ানোর কাছেই বসলাম। মেয়েটি যখন গান শুরু করল আমি তার চেহারা এবং গতিভঙ্গি ভালো করে লক্ষ করলাম। তার চেহারা মোটামুটি সুন্দর। কিন্তু তার সবচেয়ে যেটা ভালো লাগল তা হলো তার প্রতিটি আচরণের মধ্যে শিশুসুলভ এক সরলতা। গান শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে সে এগিয়ে এসে আলাপ করল আমার সঙ্গে। আমি বললাম, এটা আমার পক্ষে সৌভাগ্যের কথা যে আপনার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনেই আপনার প্রতিভার সঙ্গেও পরিচিত হলাম।
আমরা পরস্পরের মুখপানে তাকালাম। কিন্তু আমরা কেউ কথাবার্তায় আবেগের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলাম না। আমাদের আপন আপন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বাঁধ দিয়ে ঘেরা একটি ব্যবধানকে সাবধানে বজায় রেখে চললাম আমরা। আমার বিদায় নেবার সময় মেয়েটির মা ও সে নিজে আমাকে শীঘ্রই আর একবার তাদের বাড়ি যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানাল।
আমিও সুযোগ পেলেই মাঝে মাঝে তাদের বাড়ি যেতাম। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পেতাম। তার মধ্যে আমার এক মনমতো সঙ্গিনীকে খুঁজে পেলাম।
এই সময় বাবার সঙ্গে আমার অনেকদিন পর মতবিরোধ হলো।
জীবন সম্বন্ধে আমার উন্মার্গগামী দৃষ্টিভঙ্গি মোটেই ভালো লাগত না আমার বাবার। আমি সব সময় মানুষের মধ্যে যে বৃহত্তর জীবনাদর্শনের সন্ধান করে যেতাম তা কখনও কার মধ্যে খুঁজে পেতাম না। ফলে সব মানুষেরই অপূর্ণ বলে মনে হতো আমার। যারা সৎ, তারা সাধারণত ধার্মিক হয়, তারা কাজের লোক হতে পারে না। আর যারা কর্মঠ, যারা কাজের লোক, তারা বিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারে না।
আমার অন্যতম পুরনো বন্ধু জং স্টিলিং ছিল চোখের ডাক্তার। আমাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের হের ভন লার্সেনার নামে এক ধনী বয়স্ক ভদ্রলোকের দুটি চোখই খারাপ হয়ে যায়। তিনি প্রায় অন্ধ হয়ে যান। এদিকে তখন স্টিলিং চোখের ছানি অপারেশনের দ্বারা নাম করেছিল। চোখ অপারেশনে তার হাত এত ভালো যে প্রায় সব ক্ষেত্রেই সফল হয়। লার্সেনারকে শহরের ডাক্তাররা পরামর্শ দেন স্টিলিং-এর কাছে অপারেশন করতে।
সুতরাং স্টিলিংকে আসতে বলা হয় এবং ঠিক হয় সে এলে আমাদের বাড়িতে উঠবে। সে আসবে জেনে আমার বাবা-মাও খুশি হন।
যথাসময়ে স্টিলিং এসে অপারেশন করল লার্সেনারের দুটি চোখ। কিন্তু অপারেশন শেষ করার পর স্টিলিং কিন্তু খুশি হতে পারল না। সে বলল, দুটি চোখ একসঙ্গে অপারেশন করা উচিত হয়নি তার, যদিও লার্সেনার ও তার লোকজনরা তাকে তাই করতে বলেছিল। এর আগে যে স্টিলিং প্রায় একশোটি ক্ষেত্রে সফল হয়েছে, এই স্টিলিং লার্সেনারের ক্ষেত্রে সাফল্যের আশ্বাস দিতে পারল না। অথচ সফল হলে লার্সেনারের কাছ থেকে পেত প্রচুর টাকা। সে অনেক কিছু আশা করেছিল। স্টিলিং আমার কাছে স্পষ্ট স্বীকার করল, অপারেশন ভালো হয়নি। সে নিজেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি।
স্টিলিং স্বভাবত ছিল নীতিবাদী এবং ধর্ম প্রবণ। সে ভালোবাসা তার সহানুভূতিসূচক পরিবেশ ছাড়া টিকতে পারত না। সে কোথাও কোনো মানুষের কাছে। আন্তরিকতা না পেলে তাকেই মোইে সহ্য করতে পারত না। বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে একই সঙ্গে সমন্বয় করে চলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল স্টিলিং-এর। সে একই সঙ্গে ছিল বর্তমানে স্থির ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আর সে ছিল ভবিষ্যত্মখী ও আশাবাদী।
তবে স্টিলিং-এর একটা জিনিস আমার পছন্দ হতো না। সে তার জীবনের সব ব্যর্থতা ও সফলতাকে ঈশ্বরের বিচার হিসাবে ব্যাখ্যা করত। কোনও কাজে সফল হলে বলত ঈশ্বরের ইচ্ছায় সে সফল হয়েছে। আবার কোনও কাজে ব্যর্থ হলে বলত তার কোনও ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য ঈশ্বর তিরস্কার করেছেন। এই ব্যর্থতার মাধ্যমে। আমি তার একথা শুনতাম। কিন্তু কোনও মন্তব্য করতাম না। কোনও উৎসাহ দিতাম না। যাই হোক, এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে অতিশয় আঘাত পেয়েছিল সে মনে। সে হতাশায় ভেঙে পড়েছিল ভীষণভাবে। সে বলত টাকা এবং নাম-যশ দুটির থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হলো সে। এইভাবে ভগ্নহৃদয়ে বিদায় নিল সে আমাদের কাছ থেকে।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
সেদিনের সেই গানের আসরে যে মেয়েটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল সেই লিলি স্কোরেন নামে মেয়েটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ধীরে ধীরে আলাপ-পরিচয়ের সব স্তর অতিক্রম করে প্রণয়ে পরিণত হলো। প্রায়ই সন্ধ্যার সময় আমি তাদের বাড়িতে যেতাম। সে আমাকে একে একে তার নিজের ও পরিবারের অনেক কথা অনেক কাহিনী বলতে থাকে। সে বলে তার মধ্যে আমাকে আকর্ষণ করার একটা ক্ষমতা আছে। কিন্তু এবার সে হার মানতে বাধ্য হয়েছে। কারণ সে আমার দ্বারাও কম আকৃষ্ট হয়নি। এর আগে সে যেমন অপরকে আকর্ষণ করতে তেমনি কেউ তার কাছে এলে স্বচ্ছন্দে তাকে এড়িয়ে যেতেও পারত। কিন্তু এবার সে নাকি জল হয়ে পড়েছে আমার কাছে।
লিলি সাধারণত আমার কাছে সাদাসিধে পোশাক পরে আসত। কিন্তু তাকে নিয়ে কোনও নাচগানের আসরে যেতাম তখন সে রীতিমতো জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরত। অনেক গহনা পরত। কিন্তু সেই সব জমকালো পোশাক ও মূল্যবান অলঙ্কারের উজ্জ্বলতার মধ্যে আমি যেন সেই একই লিলিকে দেখতাম। দেখতে দেখতে তার সেই পোশাক ও অলঙ্কারের উজ্জ্বলতা উবে যেত আর তার চেহারাটা অনাবৃত হয়ে উঠত আমার চোখের সামনে এক অকপট স্পষ্টতায়। তার সেই স্ফীত বুকের রহস্য কতবার অনাবৃত করে দিয়েছে আমার কাছে সেই বুক একই ভাবে আছে। যে অধরোষ্ঠ কতবার চুম্বন করেছি সেই অধরোষ্ঠের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই দৃষ্টি সেই হাসি সব ঠিক আছে।