এই সব বন্ধুদের মধ্যে লেস ছিল অন্যতম। সে বড় হাসতে পারত। তার এই পরিহাসরসিকতার জন্য আমার ভালো লাগত তাকে। এই লেৎস একবার তার লেখা একটি কাব্য-নাটক আমাকে দেখাবার জন্য নিয়ে আসে। কাব্য-নাটকটি তার প্রেমাস্পদকে নিয়ে লেখা। সে এক সুন্দরী মহিলাকে ভালোবাসত। কিন্তু মেয়েটির প্রতি আরও কয়েকজন আসক্ত ছিল এবং সে তার সঙ্গে ব্যবহার করে কিছুই বুঝতে পারত
মহিলাটি তাকে ঠিক ভালোবাসে কিনা। মহিলাটি ছিল খুব খেয়ালী। এক সময় খুব ভালো থাকে, আবার এক সময় খুব রেগে যায়। যাই হোক, তার মিলনাত্মক কাব্য নাটকটি Disodatin বা সৈনিকগণ পড়ে আমার মোটেই ভালো লাগল না। আমি সরাসরি চিঠিতে জানালাম, এর মধ্যে কবিতাই নেই, তুমি এ লাইনের লোক নও। তার থেকে তুমি তোমার অভিজ্ঞতার কথা গদ্যে দিয়ে একটা প্রেমের গল্প খাড়া করার চেষ্টা করো।
এরপর আমার ‘আয়রন হ্যান্ড’ নাটকটি প্রকাশিত হলে সে তার সমালোচনা করে একখানা চিঠি দিল। আমার প্রতিভার সঙ্গে তার তুলনা করল। যাই হোক, আমি তাকে উৎসাহ দিয়ে চিঠি দিলাম। আসল কথা পেঁৎস কবিতা লিখত, সে ছিল বড় খেয়ালী। কোনও একাগ্রতা ছিল না। তাই দেশের কাব্যাক্যাশে ধূমকেতুর মতো হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে পরক্ষণেই অদৃশ্য হয়ে যায়।
অথচ আবার অন্য এক বন্ধু ক্লিঙ্গার ছিল কিন্তু লেস-এর ঠিক বিপরীত। সে দৃঢ়চেতা, অধ্যবসায়ী। সেও কবিতা লিখত এবং এখনও টিকে আছে কাব্যের জগতে। সে ছিল রুশোর ভক্ত। তার লম্বা ছিপছিপে চেহারার মধ্যে একটা ব্যক্তিত্ব ছিল।
এই সময় ল্যাভেটার নামে এক খ্রিস্টান সাধক আমাদের দেশে বেড়াতে আসে। আমার সঙ্গে তার বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে ওঠে। আমার বন্ধু ফ্রানিল কিটেনবার্গও একজন নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান। এদের দুজনের মধ্যে প্রায় তর্ক-বিতর্ক হতো। আসলে ল্যাভেটার ছিল ভক্ত। তার দেহ-মন দুটোই ছিল খ্রিস্টের উপর সমর্পিত। কিন্তু ফ্রলিন ও আমার দেহ-মনের সমস্ত চেতনা ল্যাভেটারের মতো খ্রিস্টের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল না। খ্রিস্টধর্মের মহিমা আমরা মনে মনে স্বীকার করি। মোট কথা, ভক্তি ও জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য থাকবেই সকল ধর্মসাধনার ক্ষেত্রে। ভক্তির মধ্যে মানুষ চিরকাল তার আবেগ অনুভূতি কল্পনা সব ঢেলে এক সাকার ঈশ্বরকে জড়িয়ে ধরতে চায়। কিন্তু জ্ঞান সব সময় মানুষকে টেনে নিয়ে যায় নির্বিশেষে নিরাকার ঈশ্বরের দিকে। কারণ বিশুদ্ধ জ্ঞান কখনও কোনও সীমা মানতে চায় না।
ফ্রলিন ভন কিটেনবার্গ ছিল জ্ঞানযোগী। সে নিয়মিত যোগসাধনা করত বলে আমি তার কাছে প্রায়ই যেতাম। যতক্ষণ তার কাছে থাকতাম ততক্ষণ আমার চিত্তের সকল সংক্ষোভ, অন্তরের সমস্ত দ্বন্দ্ব ও আলোড়ন স্তব্ধ হয়ে থাকত তার প্রভাবে। আমি বেশ কিছুক্ষণের জন্য এক পরম আত্মিক প্রশান্তি লাভ করতাম। আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলাম তার শরীর ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে। তবু সে যখন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে জানালার ধারে একটি চেয়ারে বসে আমার কথা অথবা আমার কোনও লেখা শুনত তখন তার দেহগত অসুস্থতার কথা একটুও জানতে পারা যেত না।
সূর্যাস্তের স্নান আলোয় ফ্রলিনের কাছে বসে থাকতে আমার খুব ভালো লাগত। মনে হতো গোটা পৃথিবীটার রূপ রং সব বদলে গেছে। মনে হতো গোধূলির ছায়াছায়া ধূসরতায় শুধু আমার নয়, পৃথিবীর সব মানুষের সব কামনা-বাসনার দূরন্ত রং মুছে গেছে চিরদিনের মতো। ফ্রলিন প্রায়ই বলত একমাত্র ঈশ্বরই মানুষের বেদনার্ত আত্মাকে চিরশান্তি দান করতে পারেন। এটা ছিল তার পরম বিশ্বাস। এ বিশ্বাসে আমি কখনও আঘাত দিতাম না কোনও ছলে।
এই সময় মোরাভীয় ধর্মমতের সঙ্গে পরিচিত হই আমি এবং ফ্রলিনের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে আসি। মোরাভীয়রা বলত মানুষের ধর্মজীবন এবং বাস্তব জীবনের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। যে সমাজে শিক্ষকরা হবে শাসক এবং ধর্মযাজক বিচারক সেই সমাজই হবে আদর্শ সমাজ।
আমি একবার যুবরাজের আমন্ত্রণে মেয়ে বেড়াতে যাই। আমার বাবা একদিন অনেক রাজসভায় ঘুরে বেড়ালেও যুবরাজ বা রাজকুমারদের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করতেন না। ফ্রলিনকে আমি মায়ের মতো জ্ঞান করতাম এবং তাকে আমার ব্যক্তিজীবনের সব কথা বলতাম। কিন্তু সে তখন শয্যাগত থাকায় তার পরামর্শ নেওয়া হলো না। যুবরাজের সঙ্গে আমার একটা বিষয়ে মতপার্থক্য হলো। উনি গ্রিক শিল্পরীতি পছন্দ করেন না। আমার মতে দেহগত শক্তি ও সৌন্দর্যের পরিপূর্ণ বিকাশই গ্রিক শিল্পকলার লক্ষ্য। এই শিল্পরীতি তাই অসংখ্যক শিল্পীকে যুগ যুগ প্রেরণা যুগিয়ে আসছে।
আমি বাড়ি ফিরে আসতেই আমার বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে আমাদের সংসারী করার জন্য পরিকল্পনা করেন। আমি কিন্তু এ বিষয়ে তখনও মনস্থির করে উঠতে পারিনি। আমার দুই-একজন বন্ধু আমাকে আমাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে পাকাপাকিভাবে। বসবাস করার জন্য অনুরোধ করে বিশেষভাবে।
আমাকে আমার কাকা নাগরিক পরিষদ থেকে কৌশলে সরিয়ে দিলেও তখন আমার কাজের অভাব ছিল না। অনেক অফিস এজেন্সিতে আমি চেষ্টা করলেই কাজ পেতাম। এই সময় একটি মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়। মেয়েটি সুন্দরী এবং গৃহনিপুণা। সবদিক দিয়ে আদর্শ স্ত্রী হবার যোগ্য। কিন্তু আমি খেলার ছলে উড়িয়ে দিলাম এ পরিকল্পনাটাকে।
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
একদিন আমার এক বন্ধু সন্ধের সময় কোনও গানের আসরে যাবার জন্য অনুরোধ করল। মানুষ কোনওভাবে একবার নাম করলেই অনেক বন্ধু জুটে যায়। অনেক জায়গা থেকে অনেক নিমন্ত্রণ আসে। গানের এই আসরটি বসবে কোনও এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে।