সাহিত্যের মধ্যে আমি যা খুঁজছিলাম হঠাৎ তা পেয়ে গেলাম। এক অভাবিত সাফল্যের সঙ্গে পূর্ণতার সঙ্গে পেয়ে গেলাম শেকসপিয়ারের মধ্যে। শেকসপিয়ার নিয়ে তখন স্ট্রসবার্গ জ্ঞানচর্চা শুরু হয়েছিল। তাঁর মূল রচনার সঙ্গে সঙ্গে জার্মান ভাষায় অনূদিত রচনাও বিভিন্ন জায়গায় পড়া ও অভিনীত হতো। শেকসপিয়ারের উপর আমার বন্ধু হার্ডার একটা প্রবন্ধ লিখেছিল। এইরকম অনেকেই লিখত তখন। আলোচনা করত চারদিকে।
হঠাৎ কি খেয়াল হতে আমি একবার ওডিলেনবার্গে তীর্থযাত্রায় যাই। সেখানে গিয়ে অদ্ভুত এক কাহিনী শুনি। রোমান আমলের এক সুপ্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মাঝে দেখতে পাই একটি ভূমিসাৎ প্রাসাদের একটি দেওয়াল আজও দাঁড়িয়ে আছে। লোকে বলত ঐখানে কোনও এক ধর্মপ্রাণা কাউন্টকন্যা একা এক পবিত্র ধর্মজীবন যাপন। করতেন। আমি সে কাহিনী শুনে সেই অদৃষ্টপূর্ণ কাউন্টকন্যার এক মূর্তি কল্পনায় খাড়া করি।
কিন্তু যখন যেখানে যাই ফ্রেডারিককাকে ভুলতে পারি না কখনও। স্মৃতির মাঝে সমানে চলে তার স্বচ্ছন্দ আনাগোনা।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
দীর্ঘ অনুপস্থিতির আর দেশভ্রমণের পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলাম। এবার কিন্তু আগের থেকে দেহমন দুটোই আমার অনেক উজ্জ্বল। মাকে আবার তেমনি মমতাময়ী ও স্নেহময়ীরূপে ফিরে পেলাম আমি। আপোসহীন অনমনীয় বাবা তার কল্পনাপ্রবণ আবেগপ্রবণ আমার মাঝে মা-ই ছিলেন একমাত্র সেতুবন্ধন। তিনি আমাদের সব দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিতেন।
এই সময় আমরা শহরে এক সান্ধ্যসভায় যাতায়াত করতাম। শহরের উচ্চশিক্ষিত বিশিষ্ট লোকরা সেখানে আসতেন। তাঁরা আমাকে সাহিত্য সৃষ্টির কাজে দারুণভাবে উৎসাহ যোগাতেন। আমার সমাপ্ত, অসমাপ্ত বা আরদ্ধ অনেক লেখা আমি তাঁদের কাছে পড়ে শোনাতাম। তারা সব মন দিয়ে শুনতেন এবং উৎসাহ দিতেন। ফাউস্টের পরিকল্পনার কথাটা তাঁদের আমি প্রথম বলি। বলি যে মেফিস্টোফোলিসের মতো এক বন্ধু সত্যিই আমি আমার জীবনের পেয়েছিলাম।
এই সময় বাইবেল নিয়েও নূতন করে পড়াশুনা করি। ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্টের সব ধর্মগত সত্যকে মেনে নিতে পারল না আমার মন। আমি সব কিছু চিরে চিরে বিচার করে দেখলাম। আমার যুক্তিবাদী প্রোটেস্ট্যান্ট ভাবাপন্ন মনে প্রথাগত ও ধর্মগত সত্য সম্পর্কে নানারকমের প্রশ্ন জাগতে লাগল।
এত সব সত্ত্বেও ফ্রেডারিকার কথাটা ভুলতে পারলাম না কিছুতেই। আর তার জন্যই কাব্যচর্চা করতে লাগলাম আবার। এই কাব্যরসই আমাকে মুক্তি দিল সকল বেদনার হাত থেকে। অন্য সব জার্মান আধুনিক কবিদের মধ্যে ক্লপস্টকের লেখা আমার ভালো লাগত। আর প্রাচীনদের মধ্যে ভালো লাগত হোমার।
ঘটনাক্রমে আমি দুজন ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হই যাদের প্রকৃতি আমার ভালো লাগে এবং যাদের জীবনকে আমি গোয়েৎস ও ওয়ার্দার এই দুই রচনার নায়ক হিসাবে মূর্ত করে তুলি। অবশ্য ওয়ার্দারের মধ্যে আমার নিজের গভীর আন্তর্জীবনের ব্যথা-বেদনার অনেকখানি মিশে ছিল। ওয়ার্দার ছিল আমার বন্ধু এবং তার অপ্রাপণীয়া প্রেমিকা লোত্তে যেন ছিল আমারও প্রেমিকা। তবে ওয়ার্দারের মতো আমার প্রেমাবেগ অতখানি ভয়ঙ্কর এবং আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারেনি।
ক্লোসার বলে আমার এক বন্ধু আমার বোনের প্রতি তার প্রেমাসক্তির কথা প্রকাশ করে। আমার বোনকে বিয়ে করতে চায় সে। আমি কিছুটা আশ্চর্য হয়ে যাই তার কথা শুনে। অবশ্য এর কোনও প্রতিবাদও করিনি আমি।
আমার বন্ধু বাগ্মী মার্ককে দেখেই আমি আমি গোয়েৎস ভন বার্লিশিঞ্জেনের কথা ভাবি। মার্ককে সঙ্গে করে আমি একবার ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে কবনেন্তস-এর পথে রওনা হই। পথে পাই রাইন নদীর উপত্যকায় অবস্থিত অনেক শান্ত সুন্দর সাজানো এক গ্রাম।
জেরুজালেম নামে একটি ছেলে তার এক বন্ধুর স্ত্রীকে ভালোবাসত। এই ব্যর্থ প্রেমের বেদনাকে জয় করতে পারেনি সে কোনওমতে। তাই সে বাধ্য হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। জেরুজালেমের এই হৃদয়যন্ত্রণা আর মৃত্যুই আমার ওয়ার্দারের পটভূমি রচনা করে। আমি তখন ওয়ার্নারের মধ্য দিয়ে জেরুজালেম ও আমার নিজের ব্যর্থ প্রেমের অনতিক্রম্য বিষাদ ও বেদনাকে এক বাঅয় রূপ দান করি। এক ভ্রান্ত আবেগপ্রবণ যুবকের অপ্রকৃতিস্থ মনের বিচিত্র গতিপ্রকৃতিকে ফুটিয়ে তুলি আমি এই রচনার মধ্যে। ওয়ার্দারের আত্মহত্যার কথা লিখতে গিয়ে আমি নিজেও এই আত্মহত্যার কথা ভাবি এবং যুক্তি দিয়ে তা সমর্থন করি।
‘ওয়ার্দারের দুঃখ’ এই ছোট বইখানি প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তার আবেদন অপরিসীম। ওয়ার্দারের দুঃখ সকল শ্রেণীর নরনারীর মর্মকে স্পর্শ করে বিদীর্ণ করে।
গোয়েৎস ভন বার্লিশিঞ্জেনকে নিয়ে লেখা নাটকখানিও সে যুগের সত্যকে অনেকখানি প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছিল।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
আমার বিভিন্ন রচনা যতই প্রকাশিত হতে লাগল ততই সাড়া পড়ে গেল আমার বন্ধুদের মধ্যে। আমার যেসব পুরনো বন্ধুদের কাছে আগে আমার কত কবিতা ও বিভিন্ন রচনা করে শোনাতাম, তাদের মতামত চাইতাম, তারা তখন ভাবতেই পারেনি সেই সব রচনা একদিন প্রকাশিত হবে ও জনপ্রিয়তা লাভ করবে।
এই সব দেখে আমার এবং আমার প্রকাশিত সাড়া জাগানো অনেক রচনা পড়ে পুরানো বন্ধুরা যেমন দেখা করতে আসত আমার সঙ্গে তেমনি অনেক সাহিত্যানুরাগী নূতন বন্ধুও জুটল।