তবু সেসেনহেম গাঁয়ের সেই সন্ধ্যাটা ভুলতে পারলাম না। ভুলতে পারলাম না ফ্রেডারিকের কথা। আমি সেখানে এক সন্ধ্যায় একটা গল্প লিখে ওদের শুনিয়েছিলাম। ওরা আগ্রহসহকারে শুনেছিল। গল্প শেষ হলে আমার আবার এই ধরনের গল্প লিখতে বলেছিল।
ওদের কথা ভেবেই আমি একদিন ঘোড়ায় করে আবার গিয়ে উঠলা সেসেনহেম গাঁয়ে।
আমি ফ্রেডারিকদের বাড়ি গিয়ে দেখলাম ওরা দুই বোন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাকে দেখেই সে তার দিদিকে বলল, সে যা বলেছিল তাই সত্য হলো। আমি আজ তাদের বাড়ি যাব একথা সে নাকি আগেই অনুমান করে তার দিদি অলিভিয়াকে বলেছিল।
অলিভিয়া হাসতে লাগল। ওদের মা আমাকে আত্মীয়ের মতোই সহজভাবে অভ্যর্থনা করলেন। পরদিন সকালে ফ্রেডারিকা আমাকে সঙ্গে করে বেড়াতে নিয়ে গেল। ওর মা ও দিদি ব্যস্ত ছিল বাড়ির কাজে। আজ ওদের বাড়িতে কয়েকজন অতিথি আসবে। সেদিন ছিল রবিবার ফ্রেডারিকার পাশে ছুটির দিনের উজ্জ্বল সকালটাকে এমন এক সুন্দর গ্রাম্য পরিবেশে কাটাতে অদ্ভুত ভালো লাগছিল আমার।
ওদের বাড়িতে ফিরে এসে দেখলাম ওদের অতিথিরা এসে গেছে, দেখলাম ওরা ফ্রেডারিকাকে খুব ভালোবাসে। আমি জীবনে যত মেয়ের সংস্পর্শে এসেছি তাদের সাধারণত দুই শ্রেণীতে ভাগ করে দেখি আমি। এক শ্রেণীর মেয়েদের ঘরের মধ্যে ভালো লাগে। ভালো লাগে তাদের পাকা গৃহিণীরূপে। আমার মন হয় ফ্রেডারিকা এমন শ্ৰেণীর মেয়ে যাকে ভালো লাগে ঘরের বাইরে। সে এখন মুক্ত আকাশের তলে বিস্তৃত পথের উপর দিয়ে চলে তখন তার দেহের অপূর্ব যৌবনসৌন্দর্য ফুল্লকুসুমিত উদার উন্মুক্ত প্রান্তরের সঙ্গে যেন মিশে এক হয়ে যায়। তার মুখের হাস্যোজ্জ্বল আনন্দ যেন নীল আকাশ থেকে টাটকা ঝরে পড়া এক আশ্চর্য বস্তু। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য সে যেন ঘরের মধ্যেও বয়ে আনে আর তাই বোধ হয় যে কোনও অপ্রীতিকর প্রতিকূল অবস্থাকে কত সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে ফ্রেডারিকা।
ওদের বাড়িতে থাকার সময় একদিন রাতে হঠাৎ লুসিন্ডাকে স্বপ্নে দেখলাম। সে স্বপ্ন উত্তেজনায় উত্তাল হয়ে উঠল আমার দেহের সমস্ত রক্ত। মনে হলো লুসিভা আমাকে আবেগের সঙ্গে ধরে আমার মুখে চুম্বন করে আমার কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। তার মুখে ফুটে উঠেছে তীব্র ঘৃণার ভাব। সে তার বোনকে অভিশাপ দিচ্ছে। অভিশাপ আমার উপরেও বেশ কিছুটা পড়েছে। আর সেই অভিশাপ বর্ষণের মাঝে স্লানমুখে দাঁড়িয়ে আছে তার বোন।
আমি আবার শহরে ফিরে এলাম। ফ্রেডারিকার বাবাকে একটা কথা দিয়েছিলাম। উনি একটা বাড়ি তৈরি করতে চান গাঁয়ে। কিন্তু ওঁর পরিকল্পিত নক্সাটা কারও পছন্দ হচ্ছে না। আমি তাই শহরে এসেই আমার এক পরিচিত স্থপতিকে দিয়ে একটা সর্বাঙ্গ সুন্দর বাড়ির নক্সা করালাম। এরপর ফ্রেডারিকাদের আসতে বললাম ঐসবার্গ শহরে। এ শহরে ওদের এক আত্মীয় পরিবার আছে। সেখানে এসে ওরা সহজেই উঠতে পারে। ওরা কিন্তু কেউ শহরে আসতে চায় না। অলিভিয়া তো একবারে গ্রাম্য আচারে-ব্যবহারে। কিন্তু ফ্রেডারিকারও কোনও মোহ বা আগ্রহ নেই শহরের প্রতি। কিন্তু আমি তো ওদের বাড়ি কতবার গেছি, কতদিন থেকেছি। আর ওরা আমার একটা অনুরোধ রাখবে না।
অবশেষে ওরা এল। কিন্তু সত্যিই আমার ভালো লাগল না। আমার মনে হলো আমি সত্যিই ভুল করেছি। যদি আমি মনোরম গ্রাম্য পরিবেশে মুক্ত আকাশের তলে প্রবহমান নদীর ধারে নুয়েপড়া গাছের ছায়ায় দেখেছি, যাদের অঙ্গলাবণ্যকে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দেখেছি, তাদের শহরের এই ইট কাঠ পাথরের কৃত্রিম পরিবেশে মোটেই ভালো লাগল না।
অবশ্য অন্তরের ভালোবাসা কোনও পরিবেশ মানে না। প্রতিকূল পরিবেশকেও অনুকূল করে তোলে। তবু পরিবেশের আনুকূল্যে ভালোবাসা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে বেশি। সার্থকতা লাভ করে সহজে। তাই ওরা যখন চলে গেল তখন আমার মনে হলো আমার বুক থেকে যেন একা ভারী বোঝা নেমে গেল। আমি আবার সহজভাবে পড়াশুনোয় মন দিতে পারলাম।
ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে পড়তে আসার সময় আমি আবার বাবাকে কথা দিয়ে এসেছিলাম আমি ভালোভাবে আইন পাশ করব। বিশ্ববিদ্যালয় লাতিন ভাষায় লেখা আমার গবেষণার কাজ সমর্থন করল। আমি আইনের ডিগ্রি পেলাম। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমায় বলল, এখন এই মুহূর্তে সেটা যেন প্রকাশ না করি। পরে ভালো করে আরও বড় করে সেটা লিখে যেন প্রকাশ করি। বাবাকে একথা জানালে তিনি আমাকে সেটা এখনি প্রকাশ করতে বললেন। কিন্তু আমি ভবিষ্যতে সেটা আবার ভালো আকারে প্রকাশ করার জন্য তার কাছে পাঠিয়ে দিলাম।
আমি ডিগ্রি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অধ্যাপক স্কফলিন মারা গেলেন। আমার মনের উপর তার প্রভাব ছিল অপরিসীম। তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত তবু পড়াশুনার অন্ত ছিল না তার। সারা জীবন ধরে তিনি রয়ে গেছেন শিক্ষার্থী। অসাধারণ হয়েও সাধারণ এই নিরহঙ্কার মানুষটি সহজেই টেনে নেন আমার মনকে। তিনি আমাদের পড়াতেন রাজনীতি।
এই সময় ফরাসি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনো করি। কিন্তু সে সাহিত্যের কাছে আমি যা আশা করেছিলাম তা পেলাম না। ভলতেয়ার যিনি দীর্ঘকাল ফরাসি সাহিত্যের ক্ষেত্রটিকে আচ্ছন্ন করেছিলেন তিনি সৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। দিদেরো, রুমা, হলবার্ক প্রভৃতি এঁদের কল্পনা এতই নিচু যে আমরা তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারিনি আমাদের চিন্তাভাবনাকে।