আমার মন কিন্তু পুরোপুরি অতীতাশ্রয়ী ছিল না। মানবজীবনের বিচিত্র অবস্থা যথাযথভাবে দেখার একটা আগ্রহও ছোট থেকে গড়ে উঠেছিল আমার মনে। ধনীর প্রাসাদ থেকে শুরু করে গরিবের কুঁড়ে আর কলকারখানা সংলগ্ন শ্রমিকবস্তিগুলো ঘুরে মানবজীবনের যে সব ছবি আমি পেয়েছিলাম সে ছবির মধ্যে কোনো সৌন্দর্য ছিল না, কোনও গুরুত্বও ছিল না। তাছাড়া সে সৌন্দর্য বা গুরুত্ব আমি দেখতেও চাইনি। তবু বলব অকৃত্রিম অকপট স্বাভাবিকতায় ভরা সে ছবির একটা নিজস্ব গুরুত্ব, একটা অন্তর্নিহিত মূল্য ছিল আমার ক্রমোদভিন্ন ও ক্রমাত্মপ্রকাশমান শিশুমনের কাছে।
একদিন ঘুরতে ঘুরতে রাজবাড়ির বাইরে এক অভিষেক উৎসবে চোখে পড়ে আমার। ছেলেমানুষ বলে দারোয়ানরা দয়া করে আমাদের ভিতরে কিছুদূর ঢুকে দেখতে দেয়। এত জাঁকজমক ও ঐশ্বর্যের ঘনঘটা জীবনে কখনও দেখিনি। তারপর বাড়িতে লোকের মুখে শুনেছিলাম আর একটি অভিষেক উৎসবের কথা। সে অভিষেক হলো সপ্তম চার্লসের অভিষেক, যে অভিষেক উৎসবে উপস্থিত ছিলেন পরমাসুন্দরী সম্রাজ্ঞী মেরিয়া থেরেসা। সে উৎসবে যেমন সব পুরুষদের দৃষ্টি দুর্বার বেগে গিয়ে পড়েছিল মেরিয়া থেরেসার উপর তেমনি সব নারীদের দৃষ্টিও কেড়ে নিয়েছিল সর্বাঙ্গসুন্দর চার্লস এর দুটি অপরূপ ভাষা ভাষা নীল চোখ।
যে কোনও মেলা ও উৎসব দেখতে ভালো লাগত আমার। যেমন সেটি বার্থোলোমিউর মেলা আর পাইপার কোর্ট উৎসব। পাইপার কোর্ট উৎসব অনুষ্ঠিত হতো শহরের যত সব বড় বড় ব্যবসায়ীদের দ্বারা অতীতের একটি দিনের স্মৃতিরক্ষার্থে। এই দিনটিতে ব্যবসায়ীরা একযোগে এক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারি চাঁদা তোলার রীতির অবসান ঘটায়। সম্রাট তাদের দাবি মেনে নেন। এই উৎসব আমার খুব ভালো লাগত। কারণ আমাদের পূর্বপুরুষদের কীর্তি-কলাপগুলোকে আমাদের চোখের সামনে যেন অবিকল মূর্ত করে তুলত। এ উৎসবে নিষ্প্রাণ অতীত হয়ে উঠত যেন রঙে রসে জীবন্ত।
আমাদের বাড়িটা নূতন হয়ে ওঠার পর যে জিনিসগুলো সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করত আমার তা হলো বাবার সংগৃহীত বই আর ছবি। বিভিন্ন ধরনের বই সংগ্রহ করার বাতিক ছিল বাবার। তার মধ্যে ছিল চিরায়ত লাতিন সাহিত্য, ইতালির কবিদের রচনা, ট্যানোর সমগ্র রচনা, আইনের বই, অভিধান আর বিজ্ঞান ও কলার বিশ্বকোষ। এছাড়া কিছু সমালোচনাগ্রন্থও ছিল। তবে প্রতি বছরই বাবা কিছু আইনের বই কিনতেন।
আগে আমাদের পুরনো বাড়িটার দোতলার ছায়ান্ধকার যে ঘরখানায় দামী ছবিগুলো সাজানো থাকত সে ঘরে মোটেই মানাত না ছবিগুলোকে। নূতন বাড়ির একটা চকচকে ঝকঝকে ঘরে যখন নূতন করে সাজানো হলো ছবিগুলো তখন তাদের। সৌন্দর্য যেন অনেকগুণে বেড়ে গেল আগের থেকে। বড় বড় ছবিগুলো সব ছিল কালো ফ্রেমে আঁটা। তবে চিত্রশিল্প সম্বন্ধে বাবার একটা বিশেষ নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তিনি বলতেন, বড় বড় শিল্পীর আঁকা পূরনো ছবি ভালো, কিন্তু বর্তমান কালের শিল্পীদের আঁকা ছবির উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বর্তমান কালের এই সব ছবিই একদিন কালোত্তীর্ণ মর্যাদা লাভ করে চলে যাবে অতীতের মধ্যে। বাবা বলতেন শিল্প-সাহিত্য বা যে কোনও বস্তুর ক্ষেত্রে অতীতের বলেই যে কোনও বস্তু ভালো হতে হবে তার কোনও মানে নেই।
এই নীতির বশবর্তী হয়েই বাবা হার্ত, ট্রটমান, বো, স্কিৎস প্রভৃতি ফ্রাঙ্কফোর্টের নামকরা শিল্পীদের বাড়িতে এনে ছবি আঁকাতেন। তাই দিয়ে ঘর সাজাতেন।
কিন্তু একবার একটি অসাধারণ ঘটনা আমার মনের ভারসাম্যকে নষ্ট করে দেয়। আমার শান্তিকে ক্ষুণ্ণ করে। ১৭৫৫ সালের ১লা নভেম্বর তারিখে লিসবন শহরে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যে ব্যাপক ধ্বংসকাণ্ড ঘটে যায় শহরে তা কল্পনাতীত আর তার খবর এক ব্যাপক সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে সারা ইউরোপের মধ্যে। এই ঘটনায় ষাট হাজার লোক নিহত হয়। অসংখ্য বাড়িঘর, চার্চ, অফিস ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। চারদিকে ফেটে যাওয়া মাটির ভিতর থেকে ধোঁয়া ও আগুন বার হতে থাকে। অসংখ্য উত্তাল সমুদ্র-তরঙ্গ ফেনায়িত করাল মুখ মেলে এগিয়ে আসে সর্বগ্রাসী। ক্ষুধায় এবং রাজপ্রাসাদের একটি বড় অংশ গ্রাস করে ফেলে। এই ভূকম্পন আরও অনেক জায়গায় অনুভূত হয়। এই ভয়াবহ ঘটনার পূর্ণ বিবরণ শুনে ধার্মিক দার্শনিক বিজ্ঞানী প্রভৃতি সকল শ্রেণীর মানুষই ভয় পেয়ে যায়। পণ্ডিতরা এ ঘটনার কোনও ব্যাখ্যাই করতে পারে না। আমার বালকমনেও এক দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এ ঘটনা। আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। যে ঈশ্বরকে কেন ধর্মশাস্ত্রের প্রথমেই বিশ্বের পরম স্রষ্টা, সংরক্ষক ও পিতা হিসাবে দেখানো হয়েছে। যিনি মানুষের ভালোমন্দ কর্মের বিচার করে পুরস্কার বা শাস্তির বিধান করে থাকেন সেই ঈশ্বর ভালোমন্দ এতগুলো মানুষকে কেন নির্বিচারে এই ব্যাপক ধ্বংসের কবলে ঠেলে দিলেন। আমি তো দূরের কথা, ধর্মতত্ত্বে অভিজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তিরাই এর কারণ খুঁজে পেলেন না অনেক চেষ্টা করেও।
ওল্ড টেস্টামেন্টে যে ক্রুদ্ধ দেবতার কথা লেখা আছে, পরের বছর গ্রীষ্মকালে একদিন সেই ক্রুদ্ধ দেবতার সাক্ষাৎ পেয়ে গেলাম হঠাৎ। তিনি আমাদের দেখা দিলেন মত্ত ঝড়ের বেগে। আমাদের বাড়ির পিছন দিকের বাগান থেকে বজ্রবিদ্যুৎসহ এক প্রচণ্ড ঝড় ছুটে এল সহসা। লণ্ডভণ্ড করে দিল আমাদের বাড়ির সাজানো ঘরগুলোকে। অনেক জানালার কাঁচ ভেঙে দিল। সে ঝড়ের প্রচণ্ডতা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। ভয়ে। আমরা ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে রেখেছিলাম। কিন্তু বাবা সেগুলো জোর করে খুলে। দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির জলে ভেসে যেতে লাগল ঘরগুলো। সত্যিই আমার বাবার মনটা ছিল শক্ত, খুব মজবুত। কোনও ঘটনার আঘাতেই সে মন ভাঙতে চাইত না। বাবা চাইতেন আমাদের মনও বাল্যকাল থেকে অমনি শক্ত ও মজবুত হয়ে গড়ে উঠবে। অমনি করে সব ভয় জয় করতে পারবে।