লুসিন্ডা বলল, আমার ভালোবাসা যদি সত্য হয় তাহলে আর কিছুই লাগবে না। সে আমার প্রেমের প্রতিদান দেবেই।
বুড়িকে টাকা দিয়ে চলে এলাম আমরা। আমি প্রায়ই তাদের বাড়ি যেতাম। একদিন এমিলিয়া তার জীবনের সব কথা খুলে বলল আমায়। সে বলল, সে আগে একটি ছেলেকে ভালোবাসত। সে এখন দূরে। তবু আজও তাকে ভালোবেসে যায়। তবে তুমি আসার পর থেকে তোমার গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারছি না। এদিকে দিদি লুসিন্ডা আবার তোমাকে ভালোবাসে অথচ তুমি আমার প্রতি আসক্ত। হায়, তুমি আমাদের দুজনের কাউকেই সুখী করতে পারলে না। একজনকে ভালোবেসে শুধু দুঃখ দিলে আর একজনকে ভালোবাসা দিতে না পেরে দুঃখ দিলে।
আমরা সোফায় বসে কথা বলছিলাম। এমিলিয়ার কথা শেষ হতে আমি তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে চুম্বন করলাম। সে বলল, এই হয়ত আমাদের শেষ দেখা। আমি উঠে পড়লাম। সে দরজার কাছ পর্যন্ত এগিয়ে এল।
এমন সময় লুসিন্ডা ঝড়ের বেগে পাগলের মতো ঘরে ঢুকল। তার বোনকে বলল, একা তোর কাছেই ও শুধু বিদায় নেবে? আমি কেউ নই? আর আগেও তুই এইভাবে আমার প্রেমিককে ছিনিয়ে নিয়েছিস।
এই বলে সে জোর করে আমাকে ধরে আমার গালে তার চোখ দুটো ঘষতে লাগল। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর আমাকে ছেড়ে দিয়ে সোফার উপর সটান শুয়ে পড়ল লুসিন্ডা। এমিলিয়া তার কাছে গেলে সে তাকে সরিয়ে দিল।
আমি কোনওরকমে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে। মনে মনে সংকল্প করলাম এ বাড়িতে জীবনে আর কোনওদিন আসব না।
দশম পরিচ্ছেদ
জুং স্টিলিং-এর মতো হার্ডারের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আমার জীবনে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আর একটা বিরাট আকর্ষণশক্তি ছিল যা আমাকে ক্রমাগত টানত তার দিকে। তার সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠভাবে মিশলেও তাকে কিন্তু আমি আমার কতকগুলো ব্যক্তিগত গোপন কথা বলিনি। যেমন গোয়েৎস ভর বার্লিসিঞ্জেন ও ফাউস্টকে নিয়ে আমি যে লেখার কথা ভাবতাম তাদের কথা বলিনি তাকে।
যাই হোক, হার্ডারের একবার অসুখ করতে বাইরে কোথাও বেড়াতে যাবার জন্য মন হাঁপিয়ে উঠল আমার। আমি সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম। হার্ডার রোগমুক্ত হতেই আমরা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে হার্ডার আর একজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আর দুজন পাবর্ত্য অঞ্চলের অধিবাসীকে নিয়ে আমি ঘোড়ায় চেপে জেবার্নের পথ রওনা হলাম।
জেবার্নে একমাত্র দেখার জিনিস হলো বিশপের প্রাসাদ। এরপর আমরা পাহাড়ের উপর উঠে জেবার্ন স্টেয়ার্স নামে এক স্থাপত্যকীর্তির বিরাট নিদর্শন দেখলাম। তখন সবেমাত্র সূর্য উঠছিল পাহাড়ের মাথায়। সেদিন ছিল রবিবার। বেলা নটার সময় আমরা পাহাড় থেকে নিচে শহরে নেমে এলাম।
এরপর আমরা বুখনওয়েলার নামে আর একটি শহরে গেলাম। সেখানে ওয়েল্যান্ড নামে আমাদের এক বন্ধু ছিল। সে আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানাল। আমরা আরও উপরে উঠার মনস্থ করলাম। পার্বত্য প্রদেশের আরও মনোরম দৃশ্য হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল আমাদের। পাহাড়ের উপর অবস্থিত লিচেনবার্গের প্রাসাদ দেখার পর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এগিয়েই সহসা সামনে দেখতে পেলাম আলসেসিরি বিশাল প্রান্তর যা দূরে-বহুদূরে পাহাড়ের ছবি আঁকা দিগন্তের কুয়াশায় মিলিয়ে গেছে।
পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়, নদী, যা কিছুই দেখি তাই বিস্ময় সৃষ্টি করে আমার মনে। তাদের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রশ্ন জাগায়। পথে কোনও নদী দেখলেই মনে হয় ছুটে যাই তার উৎসদেশে। কোনও পাহাড় দেখলেই মনে হয় তার মাথায় উঠে যাই। দেখি তার বুকের অরণ্যের মাঝে।
এরপর আমরা উত্তর-পশ্চিমের পর্বতমালার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। এগিয়ে যেতে লাগলাম লোরেনের পথে। এরপর শুরু হলো অরণ্যপথ। এক-একটা পাহাড়কে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক-একটা গহন অরণ্য। পথে যেতে যেতে একটি মুখখোলা কয়লাখনি দেখলাম। তারপর দেখলাম একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। পাহাড়ের মাথায় পাথরগুলো আগুনে পুড়ে লাল হয়ে উঠেছে। অনবরত ধোঁয়া উঠছে। পাহাড়ের কাছে যেতেই আমাদের পায়ে গরম অনুভব করলাম। কেউ জানে না কখন কিভাবে আগুন এল এখানে।
এরপর ফেরার পালা। এই সময় ইংরেজ লেখকও কবি গোল্ডস্মিথের ‘ভিকার অফ ওয়েকফিল্ড’ বইখানি আমাকে সঙ্গদান করত। বইখানির জার্মান অনুবাদ পড়তে লাগল আমার। আমার প্রিয় সেসেনহেমে ফিরে এলাম।
ওয়েল্যান্ড আমাদের সঙ্গেই ছিল। আমরা যে গাঁয়ের পান্থশালায় ডেরা নিয়েছিলাম সেখানে এক পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হই আমি। সে পরিবার ওয়েল্যান্ডের পরিচিত। পরিবার মানে দুই বোন, এ ভাই আর বাবা-মা। আমার মনে হলো, ঠিক যেন সম্প্রতি পড়া গোল্ডস্মিথের ওয়েকফিল্ড। প্রতিটি চরিত্র হুবহু মিলে যাচ্ছে। আমার অবশ্য ছোট বোনও ফ্রেডারিকাকেই বেশি সুন্দরী ও আকর্ষণীয় বলে মনে হতো, তবে বড় বোনও কম সুন্দরী নয়।
ওদের বাবার থেকে মার ব্যক্তিত্বই বেশি মনে হলো। শিক্ষিতা ও মার্জিত রুচিসম্পন্না ভদ্রমহিলাকে দেখলে একই সঙ্গে ভয় ও শ্রদ্ধা জাগে। বোন দুজনের মধ্যে দেখলাম গ্রাম্যতা ও নাগরিকতার দ্বৈত সমন্বয়ে গড়া একটা মিশ্র ভাব।
বিশেষ করে ছোট বোন সুন্দরী ফ্রেডারিকার সঙ্গে আলাপ করে তার স্বভাবের অনাবিল মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমি। একদিন তার কাছে বসে অনেকটা সময় কাটালাম। পরে ওয়েল্যান্ডকে প্রশ্ন করলাম, ফ্রেডারিকা কি কাউকে ভালোবেসেছিল বা এখনও বাসে? সে কি কারও বাগদত্তা? ওয়েল্যান্ড আমার সব প্রশ্নের উত্তরেই ‘না’ বলল। আমি বললাম, কোনও মানুষ ভালো না বাসলে এত প্রাণ খুলে হাসতে পারে না। আমার মনে হলো ফ্রেডারিক নিশ্চয় কাউকে ভালোবেসে হারিয়ে আবার তাকে খুঁজে পেয়েছে। জীবনের পরম ধনকে হারিয়ে পাওয়ার দ্বিগুণ আনন্দে তাই এত আত্মহারা। অথবা তার কোনও দীর্ঘায়িত প্রণয়সম্পর্ক আশা-নিরাশার চড়াই-উত্রাই পার হয়ে অবশেষে শুভ পরিণয়ে সার্থক হতে চলেছে।
একাদশ পরিচ্ছেদ
আবার ফিরে এলাম আমার পড়ার জায়গায়। ফিরে এলাম আমার ছাত্রজীবনে। মনের মধ্যে সংকল্প গড়ে তুললাম, আইনবিদ্যায় আমায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করতে হবে। চিকিৎসাবিদ্যা আমাকে আকৃষ্ট করলেও আমার আরব্ধ কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন করতে হবেই।