এরপর আমি স্ট্রসবার্গ শহরে আইন পড়তে গেলাম। রাইন নদীর ধারে অবস্থিত ছবির মতো সাজানো শহরটাকে আমার ভালো লাগত। শহরটার চারদিকে বড় বড় গাছে ভরা প্রান্তর। নদীর ধারটা বড় চমৎকার।
আমি সেখানে আমার আইনপড়া সম্পর্কে ডক্টর সালিকম্যান নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বললাম। আমাকে কতদিন থাকতে হবে, কতগুলো বক্তৃতায় যোগদান করতে হবে সেসব বিষয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন এখানে কাজ চালাবার মতো মোটামুটি ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়, আইনবিদ্যা গভীরভাবে পড়তে হবে জার্মানির কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি আমাকে বলতেন, এখন যা করে হোক একটা ডিগ্রি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে দাও।
এতে কিন্তু আমার মন ভরছিল না। আমি সব কিছুর ইতিহাস জানতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম আমি যা পড়ব তার ক্ষেত্রটি হবে একই সঙ্গে বিরাট ব্যাপক এবং গভীর এবং আমি তাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করব।
আমি যে বোর্ডিংয়ে থাকতাম সেখানে বেশিরভাগ সদস্য ডাক্তারি ছাত্র ছিল। তারা সব সময় চিকিৎসাবিদ্যার কথা বলত। ডাক্তারি পড়ার ছাত্রদের তাদের পাঠ্য বিষয়ের প্রতি অনুরাগের আতিশষ্যের কারণ প্রধানত দুটো। প্রথম কথা, মানুষের রোগ ও দেহতত্ত্বের ব্যাপারটার একটা নিজস্ব আকর্ষণ আছে। মানুষ হিসাবে সবাই তা জানতে চায়। আর একটা কারণ আর্থিক লোভ। ডাক্তারি পাশ করে চিকিৎসা ব্যবসায় শুরু করলেই আসবে টাকা আর প্রতিষ্ঠা। এজন্য দেখতাম ডাক্তারির ছাত্ররা সব সময় সর্বশক্তি দিয়ে পড়াশুনো করত অথবা গভীর আগ্রহের সঙ্গে পড়ার বিষয়ে আলোচনা করত।
আমি আইনের ছাত্র হলেও তাদের আলোচনার স্রোত আমাকে অনেক সময় অনেক দূরে টেনে নিয়ে যেত। দেহতত্ত্বকে কেন্দ্র করে সাধারণভাবে বিজ্ঞানের প্রতি আমার আগ্রহকে বাড়িয়ে দিত।
এমন সময় এমন একটা ঘটনা ঘটল যা আমাদের মনটাকে দিনকতকের জন্য পড়াশুনোর চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। হঠাৎ খবর এল অস্ট্রিয়ার ডিউককন্যা ও ফ্রান্সের রানি মেরি আঁতানোৎ স্ট্রসবার্গ হয়ে ফ্রান্সে তাঁর স্বামীর কাছে যাবেন। স্ট্রসবার্গে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হবে এবং শহরের বাইরে রাইন নদীর তীরে অবস্থিত এক সুসজ্জিত প্রাসাদে তিনি ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে মিলিত হবেন। এই উপলক্ষে এক বিরাট উৎসবে মেতে উঠল সারা শহর। পরে প্যারিসে বাজি পোড়ানো হলো। হুড়োহুড়ি ও পুলিশের বাড়াবাড়িতে কিছু লোক নিহত ও আহত হলো।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি ও প্রভাবশালী কর্মচারী মাসম্যান-এর সঙ্গে হঠাৎ আমার পরিচয় হয়ে গেল। সে ছিল ভালো বাগ্মী এবং বিচক্ষণ। তার সঙ্গে অনেকে মিশতে চাইত। কিন্তু আমার কিছু কিছু বিষয়ে জ্ঞান ছিল আমার বিচারবুদ্ধি সংস্কারমুক্ত ছিল বলে সে আমাকেই বেশি পছন্দ করত তার সঙ্গী হিসাবে। সে আমার হিতাকাক্ষী হিসাবে পরামর্শ দিত বিভিন্ন বিষয়ে।
আমি স্ট্রসবার্গে ফ্রান্সের রানির আগমন উপলক্ষে জীবনে এই প্রথম ফরাসি ভাষায়। একটি কবিতা লিখি।
গ্ৰেচেনের সঙ্গে আমার প্রেম সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর থেকে আমি সাধারণত আনন্দোৎসবের ঘটনাকে এড়িয়ে চলতাম। আমি নিজেকে যেন আত্মনিগ্রহের পথে ঠেলে দিয়েছিলাম স্বেচ্ছায়। ফ্রাঙ্কফুর্ট ও লিপজিগে থাকার সময় আমোদ-প্রমোদের সাধারণ উপকরণ বা উপাদান থেকে সরে থাকতাম আমি।
কিন্তু স্ট্রসবার্গে আসার পর এ বিষয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে সুযোগ পেয়ে গেলাম। একে একে নাচের আসতে যেতে শুরু করলাম। শুধু শহরের মধ্যে নয়, মাঝে মাঝে গ্রামাঞ্চলেও যেতাম। পড়াশুনোর ফাঁকে ফাঁকে অবসয় পেলেই যেমন জার্মান শিক্ষা সংস্কৃতির সম্বন্ধে চর্চা করতাম তেমনি সন্ধের দিকে কোথাও কোনও নাচগাচের আসরে সুযোগ পেলেই যোগদান করতাম।
এক সময় লার্সে নামে এক যুবকের সঙ্গে আলাপ হয় আমার। আলাপ-পরিচয় হতে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠি আমরা। সে সব সময় নিজেকে নায়ক ভাবত। সে প্রায়ই বলত ঈশ্বর তাকে নায়ক করেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। কি যুদ্ধ কি প্রেম সবেতেই সিদ্ধহস্ত সে। যুদ্ধের বীর ও প্রেমের নায়ক হিসাবে সে সব সময় তার মাথা উঁচু করে থাকবে। দ্বিতীয় কোনও ভূমিকা সে কখনও কোথাও গ্রহণ করবে না। আমি তার কথা মনে রেখেছিলাম, ‘আইরন হ্যান্ড’ নাটকে ফ্রৎস নামে একটি চরিত্রের মধ্যে তাকে মূর্ত করে তুলি আমি। সে সব সময় বড় বড় কথা বলত এবং সে কখনও কোনো অবস্থায় কারও কাছে মাথা নত করলেও আত্মমর্যাদা ত্যাগ করত না।
শুধু নাচের আসরে গেলেই হবে না। ভালো নাচ শিখতে হবে। ওয়ালৎস নৃত্য আমার শিখতে ভালো লাগত। কিন্তু এ বিষয়ে আমার কোনও পারদর্শিতা ছিল না। তাই একজন নাচের শিক্ষকের কাছে নিয়মিত নাচ শিখতে লাগলাম। তার একটা ছোট বেহালা ছিল। আমি অল্পদিনের মধ্যেই ভালোভাবে নাচ শিখে তাঁকে সন্তুষ্ট করলাম।
তার দুটি মেয়ে ছিল। তাদের বয়স তখনও কুড়ি পার হয়নি। তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। তাদের মধ্যে ছোট এমিলিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম আমি। কিন্তু এমিলিয়ার ও আমার এই ঘনিষ্ঠতা বড়বোন লুসিন্ডা মোটেই ভালো চোখে দেখত না। উল্টে ঈর্ষাবোধ করত এমিলিয়ার উপর।
একদিন এক বুড়ির কাছে তার ভবিষ্যৎ গণনা করতে যায় লুসিন্ডা। আমি তাকে ও তার বোনকে সঙ্গে করে নিয়ে যাই। বুড়ি লুসিন্ডার হাত দেখে বলে, তার প্রেমিক দূরে আছে। সে যাকে ভালোবাসে সে কিন্তু তাকে ভালোবাসে না; সুতরাং মিলনের আশা কম। তাদের প্রেমের মাঝখানে একজন অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার চিঠিপত্র লিখে বা কিছু টাকা দিয়ে দেখতে পার।