বেহরিস্ক আমায় ভালোবাসতেন। তাঁর প্রেরণাতেই নূতন করে কবিতা লিখতে শুরু করি আমি। কিন্তু বেহরিস্ক এই শর্ত চাপিয়ে দিয়েছিলেন। আমার কবিতা কখনও ছাপানো চলবে না। আমি আমার লেখা কবিতাগুলো তাঁর হাতে লিখে দেব আর তিনি সেগুলোর থেকে থেকে বেছে ভালো করে লিখে তার একটি সংকলন বাঁধিয়ে আমার হাতে তুলে দেবেন।
এই ধরনের একটা সংকলন সত্যিই সুন্দরভাবে আত্মপ্রকাশ করল রেহরিস্কের চেষ্টায়। লেখাগুলো খুবই প্রশংসা পেল। সংকলন পড়ে বাড়ি থেকে বাবা একখানা চিঠি লিখে পাঠালেন আমায় প্রশংসা করে। অধ্যাপক ক্লোডিয়াস ও গেলার্ত গদ্য ও পদ্যের রীতি সম্বন্ধে কিছু গালভরা উপদেশ দিলেও মোটের উপর ভালো বললেন।
কিন্তু হঠাৎ রেহরিস্কের মৃত্যু ঘটায় আমি দারুণ মুষড়ে পড়লাম। উনি ছিলেন একাধারে আমার বন্ধু, পরিচালক এবং প্রধান উপদেষ্টা। সেই রেহরিস্ককে বাদ দিয়ে জীবনে কিভাবে চলব তা খুঁজেই পেলাম না। এক অদম্য শোকাবেগের বিহ্বলতায় বেশ কিছুদিন কেটে গেল আমার।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
বেহরিস্কের পর যিনি আমার সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তিনি হলেন ওয়েজার। বেহরিস্কের সঙ্গে কতকগুলো বিষয়ে যেমন তার পার্থক্য ছিল তেমনি আবার কতকগুলো সাদৃশ্যও ছিল। এই কারণেই দুজনের মধ্যে আসে তুলনার কথা। সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের কথা, বেহরিস্কের মতো ওয়েজারও অন্তহীন কর্মব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দিতে চাইতেন জীবনটাকে।
ওয়েজার ছিলেন শিল্পরসিক। নিজেও আঁকতে পারতেন। তবে রেহরিস্ক যেমন কাব্যরসিক হয়েও আধুনিক কবিতা পছন্দ করতেন না তেমনি ওয়েজারও শিল্পরসিক হলেও আধুনিক শিল্প পছন্দ করতেন। তিনি প্লেজেনবার্গ প্রাসাদে অ্যাকাডেমি অফ ডিজাইন-এর অধিকর্তা ছিলেন। তবে অবসর সময়ের সমস্তটাই ছবি এঁকে কাটাতেন। প্রাচীন শিল্পরীতিতেই তিনি ছিলেন বিশ্বাসী। ওয়েজারের একটা গোঁড়ামি ছিল, একবার যদি তিনি কাউকে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা করতেন তাহলে সে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা হতে কখনও টলতেন না তিনি। কোনও অবস্থাতেই তাঁর মতের পরিবর্তন হতো না।
ওয়েজার যে ঘরে থাকতেন সে ঘরটা ছিল শিল্পরসের আবহাওয়ায় সিক্ত। বেহরিস্কের সংস্পর্শে এসে আমি যেমন নাটক ছেড়ে নূতন করে কবিতা লিখতে শুরু করি, তেমনি ওয়েজারের সংস্পর্শে এনে নূতন করে চিত্রশিল্প আঁকতে শুরু করি। তবে আধুনিক শিল্প বাজে হচ্ছে ওয়েজার-এর এ মত কিছুতেই মানতে পারলাম না আমি।
আমি আমার ছবি আঁকার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম। শিল্প সম্বন্ধে ওয়েজারের শিক্ষাদীক্ষা আমাদের মনে যথেষ্ট উৎসাহ ও প্রেরণার সঞ্চার করত। কিন্তু ওয়েজারের নিজের আঁকা ছবিগুলো মোটেই ভালো লাগত না আমাদের। তাঁর হাতে কোনও বস্তুর আকৃতিটা মোটেই ফুটে উঠত না ভালো করে।
ওয়েজারের আর একট বড় কাজ হলো থিয়েটারের জন্য একটা বড় বাড়ি নির্মাণ। সে বাড়ির সামনে প্রাচীন গ্রিক নাট্যকার সোফোক্লিস ও অ্যারিস্টোফেনস-এর মূর্তি স্থাপন করা হলো আর সেই সব মূর্তি চারপাশে রইল আধুনিক জার্মানির নাট্যকারদের মূর্তি। আবার তার সঙ্গে ছিল কলাবিদ্যার বিভিন্ন অধিষ্ঠাতী দেবীর ছবি।
ওয়েজার চিত্রশিল্প সৃষ্টির কাজে নিজে খুব সার্থক না হলেও আমাদের আঁকার কাজে শিক্ষা দিতেন ভালো। আঁকার কাজে শিক্ষার্থীদের কোথায় কি ত্রুটি তা ঠিক করতে পারতেন। তবে নিজের হাতে কোনও বিষয়ে দেখিয়ে না দিয়ে তিনি শুধু আমাদের দোষটা ধরিয়ে ভাবতে বলতেন যাতে আমরা নিজেরাই উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারি।
এই সময় দার্জেনভিলের লেখা চিত্রকরদের জীবনী গ্রন্থটি জার্মান ভাষায় অনূদিত হলো। সেই অনুবাদটির মধ্য দিয়ে চিত্রকলার এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠলাম আমরা। আবার আমার মনে এই সব বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন শিল্পীর ছবি দেখে কবিতা লেখার প্রেরণা জাগত আপনা থেকে।
ওয়েচারের আর একটা গুণ ছিল। মৃত ব্যক্তিদের ছবি আঁকতে ভালোবাসততা। মৃতদের স্মরণ করার একটা ঝোঁক ছিল।
তখন লিপজিগ শহরে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির সমন্বয় ঘটেছিল। এঁদের মধ্যে তিনজন ছিলেন বেশ নামকরা। তাঁরা হলেন হুবার, কুশপ আর উইঙ্কলার হুবার জার্মান সাহিত্যের ইতিহাসটাকে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেন। এটা সত্যিই বিরাট কাজ যার জন্য ফরাসিরা কৃতজ্ঞ থাকবে চিরদিনের জন্য। বাকি দুজন ছিলেন শিল্পরসিক।
কিন্তু আমাদের চূড়ান্ত রসতৃপ্তি ঘটেনি। কিছুতেই মন ভরছিল না আমাদের। আমরা চাইছিলাম এর নূতন আলো। চাইছিলাম আমাদের পরিচিত কোনও শিল্পী সে আলো নিয়ে আসবে।
মানুষের মন সাধারণত দুভাবে আনন্দ পায়। এক হচ্ছে প্রত্যক্ষীকরণ আর অন্যটি হলো ধ্যানধারণা। প্রত্যক্ষীকরণের মধ্য দিয়ে আনন্দ পেতে হলে হাতের কাছে পার্থিব বস্তু বা উপাদান ভালো থাকা চাই। কিন্তু ধ্যানধারণার একটা সুবিধা এই যে, এর মাধ্যমে বাস্তব প্রতিরূপ ছাড়াই কোনও ভালো বিষয়বস্তুকে মনের মতো উপভোগ করা যায়।
এই সময় আমি আর্নল্ডের ‘মি হেস্ট্রি অফ দি চার্চ অ্যান্ড অফ হেরেটিকস’ নামে একখানি বই পাই হাতে। বইখানি পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আর্নল্ডের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রেই আমার মতের মিল হয়। যুগে যুগে দেশে দেশে ঈশ্বর সম্বন্ধে মানুষের ধারণা যাই হোক, ধর্মের ইতিহাস ও দর্শন আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে মানবাত্মা নিরন্তর সংকোচন ও প্রসারণের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য সাধন করে চলেছে। মানুষের সত্তাটি একাধারে আত্মগত ও বিশ্বগত। কখনও সে সত্তা বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে নিজের মধ্যে নিজেকে কেন্দ্রীভূত করে সংগঠিত করে চলেছে, আবার কখনও বা নিজেকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দিকে সম্প্রসারিত করতে চাইতে। নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চাইছে।
নবম পরিচ্ছেদ
বসন্তকাল আসতেই আমি ভালোভাবে সেরে উঠলাম। আমি আমার হারানো স্বাস্থ্য আবার ফিরে পেলাম। আর আমার বাড়িতে থাকতে ভালো লাগছিল না। তাছাড়া বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও ভালো যাচ্ছিল না। তিনি এমনভাবে কথা বলতেন জীবনের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে যাতে মনে হতো সব কিছু মানুষের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, মানুষ যেন ইচ্ছামতো জীবনের যে কোনও ঘটনাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। কথায় কথায় আমিও কয়েকটি ক্ষেত্রে আঘাত দিয়ে ফেলেছি তাঁকে।