প্রাণমাতানো এক চঞ্চল খেলা মেতে উঠত তাঁর লেখার মধ্যে। এই আবহাওয়ার মধ্যে আমিও লেখা শুরু করে দিলাম। কবিতা লেখার উপর জোর দিলাম। আবার কিছু লেখা বাড়িতে বাবার কাছে ফেলে আসি। তারপর এখানে এসে বহু সুযোগ্য। সাহিত্যরসিক ব্যক্তির সঙ্গে মেলামেশার ফলে আগের থেকে অনেক পরিণত লেখাও কিছু লিখি। কয়েকটি প্রবন্ধও লিখেছিলাম।
এই সময় গ্রেনেচের মতো আর একটি মেয়ের প্রেমে পড়ি। সেও হোস্টেলে কাজ করত। তার নাম ছিল অ্যালেত্তে। মেয়েটি গ্রেনেচের মতোই ছিল সুন্দরী। কিন্তু গ্ৰেচেনের থেকে অনেক শান্ত ও স্বভাবা। গ্ৰেচেনের তেজস্বিতা ও দৃঢ়তা তার ছিল না। সে আমাদের খাবার তৈরি করত, রাত্রে মদ এনে দিত। আমাদের ফরমাশ খাটত। তাকে খুব ভালো লেগে গেল আমার। এই ভালো লাগা যতই ভালোবাসায় পরিণত হয়ে উঠল ততই তার চরিত্র সম্বন্ধে সন্দেহ জাগত আমার মনে। আমি বেশ বুঝতে পারলাম এ সন্দেহ অকারণ, সত্যিই সে নিরীহ। তবু মন আমার বুঝত না। কেবলি মনে হতো সে হয়ত গোপনে আরও কাউকে ভালোবাসে, মনে হতো হয়ত হে বহুবল্লভা। অথচ আমি জানতাম অ্যালেত্তে আমায় মন-প্রাণ নিয়ে ভালোবাসে এবং আমাকে খুশি করার জন্য সে অনেক কিছু করে। তবু একদিন আমি আমার সন্দেহের কথা তাকে বলে কত মনোকষ্ট দিলাম তাকে।
তবে অ্যালেত্তের প্রতি আমার আবেগের প্রবণতাটা কমতে আমি প্রেমিকাদের খামখেয়াল নামে একটি নাটিকা লিখে ফেললাম। গ্ৰেচেনের সঙ্গে গভীরভাবে মিশতে যে পরিণাম ভোগ করতে হয়েছিল আমার তাতে একটা শিক্ষা হয়েছিল। আমার তথাকথিত ভদ্র সমাজটাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনেছিলাম। যে অভিজাত সমাজ মুখে বড় বড় ন্যায়-নীতি, আইন-কানুন প্রভৃতির কথা বলে তারাই সুড়ঙ্গপথে পার করে বেশি। এই নৈতিক অনুশাসন সব বইয়ের ব্যাপার। মুখের কথা যা শুধু সমাজের উপরিপৃষ্ঠে ভেসে বেড়ায়। সমাজের গভীরে বা মানুষের বাস্তব আচরণে তার কোনও স্থান নেই। শহরের পিচঢালা মসৃণ রাজপথের দুধারে বড় বড় সুদৃশ্য বাড়িগুলোতে যারা বাস করে তারা লোকচক্ষে দ্র ও অভিজাত শ্রেণী। সবাই তাদের খাতির করে। কিন্তু সেই সব বাড়িতে ঘুরে ঘুরে আমি দেখেছি অবৈধভাবে টাকা রোজগার, অবৈধ সংস্পর্শ, স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া, বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রভৃতি নানা অকর্ম-কুকর্ম ও অশান্তি লেগেই আছে। সেখানে। তার উপর তাদের বাড়িতে খুন, ডাকাতি, মেয়ে নিয়ে অশান্তি, বিষ খাওয়া প্রভৃতি কত অশান্তি। অনেক সময় অনেক পরিবারের বন্ধু হিসাবে আমি তাদের বিপদে সাহায্য করতাম। সেই সব বিপদের কথা বাইরে প্রকাশ করতাম না। এই সব পরিবারের কোনও নোংরামি বা দুর্ঘটনার কথা বাইরে বড় একটা প্রকাশ হতো না বলে কেউ জানতে পারত না। এই সব পারিবারিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা নিয়ে আমি দু-একটা নাটকও লিখেছিলাম। কিন্তু যত কুকর্মের কথা স্কুলভাবে বলা ছিল বলে সে নাটক সার্থক শিল্পরসে উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
এরপর কিছু হাসির নাটক লিখি আমি। এই সময় মাদাম বমি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকে আমি আর বিশেষ যেতাম না তাদের বাড়িতে। তার স্বামীর বক্তৃতা আমার ভালো লাগত না। তিনি আমাকে প্রায়ই বকতেন। তাই আমি তাঁকে এড়িয়ে চলতাম। একদিন তার ক্লাসে আমি তার বক্তৃতার নোট না লিখে আমার খাতার পৃষ্ঠায় ছবি আঁকছিলাম। তাই দেখে আমার পাশের ছাত্ররা অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল।
আমার অমনোযোগী মনটাকে আরও গভীর ও আগ্রহশীল করে তোলার জন্য অধ্যাপক লোকটি আমাকে ধর্মের দিকে টানার চেষ্টা করলেন। নিয়মিত চার্চে যাওয়া, স্বীকারোক্তি করা, সমবেত প্রার্থনা ও যোগ প্রভৃতির প্রতি অভ্যাস গড়ে তুলতে বললেন। এসবও আমার ভালো লাগত না। তবু গেলার্তকে আমাদের ভালো লাগত। তাছাড়া প্রোটেস্ট্যান্টদের ধর্মীয় রীতিনীতি আমার মোটেই পছন্দ হতো না। অথচ গেলার্ত আমাদের বোঝাতে চাইত ক্যাথলিকদের থেকে প্রোটেস্ট্যান্টদের রীতিনীতি অনেক ভালো। এখানে স্বীকারোক্তির জন্য বাধ্য করা হয় না কোনও মানুষকে। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে স্বীকারোক্তির পক্ষে, কারণ মানুষ অনেক গোপন অব্যক্ত কথা ব্যক্ত করে হালকা হয়ে ওঠে মনে মনে। আমার এই ধরনের একটা গোপন কথা ছিল। ধর্ম সম্বন্ধে এক বিরাট সংশয় ছিল আমার মনে। এই সংশয়ের কথা আমি স্বীকারোক্তির মাধ্যমে ব্যক্ত করতে চাই কোনো সহৃদয় মানুষের কাছে। কিন্তু তারও কোনো ব্যবস্থাই নেই আমাদের ধর্মীয় রীতিতে।
হঠাৎ এক মহান ব্যক্তির সংস্পর্শে এলাম লিপজিগ শহরে। আমি যেন এই ধরনের একটা মানুষকেই খুঁজছিলাম। তিনি হলেন বেহরিস্ক। আগে তিনি কাউন্ড লিন্দেনাদের ছেলের গৃহশিক্ষক ছিলেন। তাঁর বয়স ছিল তিরিশের কিছু বেশি। রোগা অথচ সুগঠিত চেহারা। লম্বা নাক। সাদাসিধের উপরেই বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরতেন।
বেহরিস্ক এক অদ্ভুত মানুষ। কবিতা তিনি ভালোবাসতেন। তবে আধুনিক কোনও কবির কবিতা ভালো লাগত না তাঁর। আমার সঙ্গে এ বিষয়ে কিছু অমিল ছিল তাঁর। তবু বেহরিস্ক তাঁর সেই ভালো না লাগার কথা এমন সুন্দরভাবে বুদ্ধির সঙ্গে পরিহাসরসিকতা মিশিয়ে বলতেন আর তার উপর আমি কিছু বলতে পারতাম না। তাছাড়া তাঁর জার্মান ভাষা ও সাহিত্যে পড়াশুনা ছিল প্রচুর। লিখতেও ভালো পারতেন। এক উন্নতমানের রুচিবোধ ছিল তাঁর আর তাই দিয়ে যে কোনও কবিতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ভালো-মন্দ দিকগুলো বলে দিতে পারতেন তিনি।