লিপজিগ বিরাট শহর। কাজ-কারবারের প্রচুর ভিড়। অসংখ্য কর্মব্যস্ত মানুষের বিপুল আলোড়নে সব সময় স্পন্দিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে হাথ বমি নামে একজন অধ্যাপকের হাতে পরিচয় পত্র দিলাম। তিনি ইতিহাস আর আইনবিদ্যার অধ্যাপক। কিন্তু আমার আইন মোটেই ভালো লাগে না। আমার ঝোঁক হচ্ছে প্রাচীন বিষয়ের সাহিত্য পাঠের উপর। প্রথমেই কথাটা বললাম না।
পরে অবশ্য আমার ইচ্ছার ব্যাপারটা শুনে আমাকে ভালো করে বোঝালেন হাথ। তিনি বললেন আইন পড়লে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পরিষ্কার হয়। তাছাড়া আমার বাবার একান্ত ইচ্ছা আমি আইন পড়ি। মনে আমার যাই হোক, হাথের কথা ও যুক্তি আমার ভালো লাগল। অধ্যাপকদের মধ্যে হফ্রাথকেই আমার খুব ভালো। লেগেছিল। তাঁর স্ত্রীও আমাকে ছেলের মতো ভালোবাসতেন। তিনি রুগ্ন বলে বাড়ি থেকে সন্ধ্যার দিকে কোথাও বেরোতেন না। তাই আমাকে রোজ সন্ধ্যার সময় যেতে বলতেন তাঁদের বাড়ি। আমার কাছে অনেক বড় বড় পরিচয়পত্র ছিল। আমি অভিজাত বংশের ছেলে। তাই অল্প দিনের মধ্যেই শহরের অভিজাত সমাজের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠলাম। তাদের মনমতো পোশাক পরে ও তাদের মনমতো ভাষা বলে তাদের সঙ্গে অনেক মিশতাম। কিন্তু তাদের আদবকায়দা আমার ভালো লাগত না।
তর্কবিদ্যার জন্য দর্শনবিদ্যার ক্লাসে যেতে ভালো লাগত না আমার। তাছাড়া দর্শনের অধ্যাপক জগৎ, জীবন, আত্মা, ঈশ্বর সম্বন্ধে যা বা বলতেন তা আমার আগে থেকে জানা ছিল না।
আইনবিদ্যর ক্লাসেও ঐ একই অভিজ্ঞতা। আমার কাছে আইনের যে সব বই ছিল এবং যেসব তত্ত্ব ও বিষয় পড়তাম, বুঝতাম, শিখতাম, অধ্যাপক তাই বোঝাতেন। কিন্তু নূতন কথা বলতেন না। এজন্য তার বক্তৃতার সব কিছু খাতায় লিখে নেবার কোনও উৎসাহ পেতাম না। অবশ্য আমি এটাও উপলব্ধি করলাম, আমি যে পরিমাণ পড়েছি সেই পরিমাণে পাঠ্য বিষয়গুলো হজম বা আত্মসাৎ করতে পারিনি। এজন্য আরও সময় দরকার।
প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও অভিজাত সমাজের মেয়ে-পুরুষের প্রতি কিছুদিন পর বিতৃষ্ণা জেগে উঠল আমার মনে। আমার মনে হতে লাগল, ওরা যেন আমার সব স্বাতন্ত্রকে গ্রাস করে নিতে চাইছে। ওরা চাইছে আমি নিজেকে নিঃশেষে হারিয়ে ফেলি ওদের মাঝে। আমার এতদিনের ধ্যান-ধারণা, ভাবধারা, চিন্তা, কল্পনা সব কিছু নস্যাৎ করে দিয়ে তার জায়গায় ওদের চিন্তা, ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।
তাই অভিজাত সমাজের সভা-সমিতির থেকে মাদাম বমির সাহচর্য আমার অনেক ভালো লাগত। উনি জার্মান কবিতার একজন বড় সমঝদার ছিলেন। উনি যখন দেশের আধুনিক কবিতার সমালোচনা করতেন তখন আমি তা মন দিয়ে শুনতাম। উনি বলতেন, যে সব দুর্বলমনা কবি বসন্তকালীন সুখপিয়াসী পাখির মতো শুধু বসন্তের গান গায় তাদের আমি দেখতে পারি না। আমি ভালোবাসি সেই সব কবিতা যার মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে উপস্থাপিত হয়েছে চিরকালের কোনও শাশ্বত কথা বা কাহিনী।
তাঁর স্বামী হাথ বমি সাধারণভাবে কবিতা মোটেই পছন্দ করতেন না। হাত দম্পতির বাড়িতে আর একজন সহৃদয় অধ্যাপকের সংস্পর্শে আমি আসি। তিনি হলেন অধ্যাপক মোরাস। উনিও মাদাম হফ্রাথকে সমর্থন করতেন কবিতার আলোচনায়। মোরাসের মিষ্টি ব্যবহার আমার এত ভালো লেগে গেল যে আমি তার বাড়ির যাওয়া আসা শুরু করেছিলাম। মাদাম বমির থেকে আরও যুক্তিপূর্ণ ও পরিণত ভাষায় চিরায়ত সাহিত্য সম্বন্ধে আমার বুঝিয়ে দিতেন মোেরাস।
জেনেমিয়াদস নামে আরও একজন অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমার। তিনি কবিতা মোটেই ভালোবাসতেন না। তিনি শুধু প্রবন্ধ লিখতে বলতেন। আবার আমার কোনও গদ্য রচনাও ভালো লাগত না তার। তিনি বলতেন আমার গদ্য রচনায় রীতি বড় সেকেলে। তাছাড়া তার মধ্যে যে পরিমাণে রোমান্সের আবেগ আছে সে পরিমাণে জীবনবোধমূলক কোনও সারবস্তু নেই। আমিও তা স্বীকার করলাম। চিঠিতে মানুষ যেমন তার প্রিয়জনদের কাছে আবেগ প্রকাশ করে তেমনি আমারও সব লেখাতেই আবেগের আতিশয্য এসে যেত।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
আমি যে যুগে জন্মেছিলাম সে যুগ জার্মান সাহিত্যের ক্ষেত্রে সমগ্রভাবে ছিল সমৃদ্ধির যুগ। তার পূর্ববর্তী যুগের সাহিত্য ছিল বিদেশী ভাষা ও চিন্তাধারার দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিত। রাজনৈতিক কারণে বিদেশী প্রভাব অনুপ্রবিষ্ট হয়ে যায় কাব্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে। সেই প্লাবন দ্বারা আনীত পলিমাটিতে যে সৃষ্টি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে তার মধ্যে স্বদেশী ভাষা আর স্বদেশী চিন্তাধারাই ছিল প্রধান উপজীব্য। যে যুগের নামকরা লেখকদের মধ্যে লিসকাউ, রাবেনা ও গটশেভ, বেলির প্রভৃতির নাম অবশ্যই করতে হয়। সৃজনশীল সাহিত্যের সঙ্গে সমালোচনা সাহিত্যও উন্নত হয়ে উঠেছিল বিশেষভাবে।
আমি যে সব সাহিত্যরসিক বন্ধুদের সঙ্গে খুব বেশি মিশতাম তারা হলেন ক্লোজার আর কেনেন। তাছাড়া বিভিন্ন সাহিত্যগোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসে লেখা আর সমালোচনা পড়ে আমার একটা ধারণা স্পষ্ট হলো। আমাদের যুগের সাহিত্যের সবচেয়ে বড় দোষ এই যে সে যুগে সব লেখাই অনাবশ্যকভাবে আবেগপ্রধান ও দীর্ঘায়িত হয়ে উঠত। তাতে আসল বক্তব্য খুব কম থাকত আর যাও বা থাকত বা অস্পষ্টভাবে কুয়াশায় ঢাকা। আমি বুঝলাম লেখার মধ্যে আরও স্পষ্টতা, পরিমার্জিত চিন্তাশীলতা ও সংক্ষিপ্ত হওয়া প্রয়োজন। আমার কিন্তু রেনির আর উইল্যান্ডের লেখা খুবই ভালো লাগত। উইল্যান্ডের লেখার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল আলোছায়ার এক অপূর্ণ খেলা। বাস্তব অভিজ্ঞতার এক প্রখর প্রতপ্ত আলোর ঝলকানির সঙ্গে অবান্তর এক আদর্শের ছায়াপথ।