কথাটা শুনে কিন্তু মনে দুঃখ পেলাম আমি। গ্ৰেচেনের উপর রাগও হলো। গ্ৰেচেন আমাকে ছেলেমানুষ ভেবে তুচ্ছজ্ঞান করেছে। যে একদিন আমার লেখা কবিতার প্রশংসা করেছিল নিজের মুখে সেই ঘেঁচেন আমাকে তুচ্ছ ভেবে আমার গুরুত্বকে উড়িয়ে দিয়েছে। ভাবলাম গ্রেচেনের নাম আর করব না। তার কথা কখনও ভাবব না।
আমার দেখাশোনার জন্য যিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন তাকে আমি আমার ‘ওভারসিয়ার’ বলতাম। একটু সুস্থ হলে আমি আমার ওভারসিয়ারের সঙ্গে বেড়াতে বার হলাম একদিন। কিন্তু শহরের পথে বার হতেই আমার মনে হতে লাগল পাইলেদস আর তার বন্ধুদের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে। তাদের সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর কথা ভেবে আমার কষ্ট হতে লাগল মনে। যেদিকেই তাকাই ভয় ভয় ঠেকে, যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তাহলে কি বলব তাদের? তাদের দেখা না পেলেও তাদের প্রেতগুলো যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরের পথ পথে-ঘাটে। আমি ওভারসিয়ারকে বললাম বন দিয়ে বেড়াতে চলুন। লোকালয় ভালো লাগছে না।
ফার, ওক প্রভৃতি বড় বড় গাছগুলোর শীতল ছায়ার মধ্যে বসে বসে ভাবতে বড় ভালো লাগছিল আমার। তবে কোনও কথা নয়, শুধু একা থাকতে মন চাইছিল আমার। আমি একটা গাছের তলায় একা একা বসেছিলাম। আমার ওভারসিয়ার ছিলেন একটু দূরে। নির্জন বনভূমির শান্তশীতল স্তব্দতায় আমার অন্তরের সব জ্বালা, দুঃসহ স্মৃতির সব উত্তাপ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। বনভূমিতে এ ফাঁকা মাঠে ঘুরে বেড়িয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য নিয়ে ছবি আঁকার শখ হলো আমার। আমার দু’একটা ছবি দেখে বাবাও খুশি হলেন। তিনি নিজে ছবি ভালোবাসতেন। আমার ওভারসিয়ার এইসময় বাবাকে বললেন আমি দেহ ও মনের দিক থেকে সেরে উঠেছি। আমি খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছি নিজেকে বর্তমানের পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে।
আগের থেকে কিছুটা স্বাধীনতা পেলাম আমি। বাইরে বেড়াতে দেওয়া হলো আমাকে। পাহাড় অঞ্চলে চলে গেলাম বেড়াতে। হামবার্গ ক্রোনবার্গ থেকে শুরু করে রাইনের উপত্যকা পর্যন্ত বেড়ালাম। কিছু ছবিও আঁকলাম। কিন্তু ছবিগুলো তাড়াহুড়ো করে আঁকায় মোটেই ভালো হয়নি। ছবি নয় যেন কতকগুলো ছবির কাঁচা উপাদান। তবু বাবা ধৈর্য ধরে সেগুলো নিয়ে উৎসাহের সঙ্গে বসে গেলেন। সম্পূর্ণ বা আংশিক সংশোধনের চেষ্টা করতে লাগলেন।
আমার বাবা ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতেন না। তিনি ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাওয়া-দাওয়ার উপর নজর রেখেছেন, পিতার কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন এতেই তিনি সন্তুষ্ট। মা ছিলেন শিশুর মতো সরল, আত্মভোলা। বাড়িতে আমার বোনই যেন একমাত্র কথা বলার লোক। আমার থেকে মাত্র এক বছরের ছোট আমার বোনই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু।
এই সময়ে এক ইংরেজ যুবকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। তার কাছে আমি ইংরেজি ভাষা শিখতাম। আর সে আমার কাছে জার্মান ভাষা শিখত। সে প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসত। আমার বোনকে ভালোবাসত সে এবং ইংরজি ভাষাতে সে তার ভালোবাসার কথা জানাত। ছেলে হিসাবে সত্যিই সে ছিল যোগ্য সব দিক দিয়ে। লম্বা, ছিপছিপে চেহারা, মুখ-চোখ স্বাভাবিক। মুখে ছিল কিছু কিছু বসন্তের দাগ। আমার বোনের চেহারাটাও বেশ লম্বা আর সুগঠিত ছিল। মুখখানা তত সুশ্রী ছিল না। এ নিয়ে আমার বোনের দুঃখ ছিল মনে। কিন্তু গুণের দিক থেকে সে ছিল তুলনাহীন।
মাঝে মাঝে আমরা প্রমোদভ্রমণে বার হতাম। বেশিরভাগই নৌকোয় করে জলপথে যাওয়া হতো। সবাই প্রায় জোড়ায় জোড়ায় অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী অথবা প্রণয় প্রণয়ীতে মিলে যেত। আমার বোনও তার সেই ইংরেজি প্রণয়ীকে সঙ্গে নিয়ে যেত। একমাত্র আমারই কোনও সঙ্গী ছিল না। আমি শুধু একা একা তাদের সব আনন্দ লক্ষ করে যেতাম। তাই নিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম। তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতাগুলোকে আমার অনুভূতির রসে ভিজিয়ে আমার কবিতার মধ্যে নূতনভাবে রূপ দেবার চেষ্টা করতাম।
এমনি করে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল। নূতন। পরিবেশে গিয়ে কেমন লাগবে, আমার জীবন কি রূপ নেবে, আমার শিক্ষাদীক্ষা কেমন হবে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত রইল না আমার মনে। তবে একটা বিষয়ে আশ্বস্ত হলাম আমি। অর্থাৎ আমাদের শহরটা ফেলে দূরে থাকতে পারব। গ্ৰেচেনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পর থেকেই শহরটাকে আর মোটেই ভালো লাগত না আমার। মনে হতো এ শহরটা থেকে অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে পেলে বেঁচে যাই। আমার জীবন থেকে গ্ৰেচেন চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার যৌবন-জীবন হতে প্রথম প্রেমের সবুজ সজীব চারাগাছটা মূল সমেত উৎপাটিত হয়ে যায় একবারে। তার জায়গায় কোনও নূতন চারাগাছ গজিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। আমি আর শহরের মধ্যে। গ্ৰেচেনদের পাড়া দিয়ে যেতাম না। গোটা শহরটা আমার বন্দিশালা বলে মনে হলো।
আর কোনও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আগের মতো মিশতাম না আমি। বেশি কথা খুব একটা বলতাম না। কবিতাই ছিল আমার অবিরাম সহচর। সময় কাটাবার একমাত্র উপায়।
অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার দিনটি এসে গেল। পুস্তক-বিক্রেতা ফ্লেসার সম্প্রতি আমার সঙ্গী ছিলেন। ফ্রেসারের স্ত্রী উইটেনবার্গে তাঁরা বাপের বাড়ি যাচ্ছে। আমরা যাব লিপজিগ। জীবনে প্রথম বাড়ি-ঘর, শহর, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে দূরে যাচ্ছি আমি। প্রত্যেককেই একবার করে যেতে হয়। এটাই হয়তো প্রকৃতির নিয়ম। কারণ এইভাবেই মানুষ স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে তখনই সে বাড়ি-ঘর, বাবা-মা, ভাই-বোনের সাহচর্য ও সাহায্য ছেড়ে স্বাধীনভাবে কোথাও গিয়ে নিরাপদ জীবনযাপন করতে চায়।