তবু আমার মনে হলো গ্ৰেচেনের মতো সুন্দরী মেয়ের পক্ষে ঐ দোকানের কর্মচারিণীরূপে মোটেই মানায় না।
একদিন সন্ধ্যার সময় হোটেলে খাবার পর একটা মজার খেলা হলো। গ্ৰেচেন ও তার এক জ্ঞাতি ভাই কবিতা লেখা শিখতে লাগল আমার কাছে। মোটমুটিভাবে তাদের একে একে শিখিয়ে দিতে লাগলাম কিভাবে ছন্দ অলঙ্কার ইত্যাদি প্রয়োগ করতে হয় কিন্তু শিখিয়ে দিলেও তারা তা পারল না। তবু গ্ৰেচেন কাছে থাকায় আমার খুব ভালো লাগছিল খেলাটাকে।
একদিন সন্ধ্যায় সময় তারা ডেকে বলল জোশেফ রাজা নির্বাচিত হচ্ছে। অভিষেক উপলক্ষে দারুণ ধুমধাম হবে। সত্যিই অভিষেক উপলক্ষে সে উৎসব চলল, নানারকমের ঐশ্বর্যের যে বিপুল সমারোহ দেখলাম তার তুলনা হয় না।
সেদিন সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে আমার ঘরে বসে আমি বিশ্রাম করছি এমন সময় মা এসে মুখ ভারী করে বললেন, শুনেছি আজকাল তুমি নাকি কুসঙ্গে মিশছ। আমাদের কানে সব কথা এসেছে। তুমি তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলো।
কোনও এক তৃতীয় ব্যক্তির দ্বারা তিনি সমস্ত ব্যাপারটার তদন্ত করবেন। কাউন্সিলার স্লিদেলই তদন্ত করবেন।
স্লিদেলের কথা মনে পড়ল আমার। একদিন উনিই ‘মেসিয়া’ নামক একটি কাব্যগ্রন্থ আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিয়েছিলেন আমাদের।
স্লিদেল এসে আমার সামনে চোখে জল নিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, তোমার মতো এক নিরীহ যুবক সঙ্গদোষে ধাপে ধাপে নরকের পথে নেমে যাবে এটা খুবই পরিতাপের বিষয়।
আমি বললাম, আমি জ্ঞানত কোনও অন্যায় বা অপরাধ করিনি এবং কোনও কুসঙ্গেও মিশিনি।
স্লিদেল বললেন, দেখো, আমাদের বাধা না দিয়ে কথাটা স্বীকার করাই ভালো।
আমি বললাম, কি জানতে চান আপনি?
স্লিদেল বললেন, তুমি একটি লোকের চাকরির জন্য তোমার দাদামশাই-এর কাছে সুপারিশ করেছিলে?
আমি বলল, হ্যাঁ করেছিলাম।
স্লিদেল আরও তিনজন ছেলের নাম করে বললেন, তুমি এদের সঙ্গে মেলামেশা করো?
আমি বললাম, প্রথম ছেলেটি ছাড়া আমি ওদের কাউকেই চিনি না।
স্লিদেল তখন আমার উপর স্বীকারোক্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করতে লাগলেন। বললেন, তুমি কোথায় কোথায় যাও, কার কার সঙ্গে মেশো আমরা সব জেনেছি। আমার কাছে স্বীকার না করলে ম্যাজিস্ট্রেটের লোক আসবে। সেটা খুব খারাপ হবে। তুমি অপরের হয়ে চিঠি লিখে দিয়েছ। অনেক জাল চিঠি ধরা পড়েছে।
আমি মনে মনে ভাবলাম, কার্যত আমি কোনও অন্যায় করিনি ঠিক তবে আমি নিম্নশ্রেণীর এমন সব ছেলেদের সঙ্গে মিশেছি যারা যে কোনও অপরাধ করতে পারে। অবশ্য তারা আমার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করেনি।
অবশেষে আমি স্লিদেলকে বললাম, যা যা হয়েছে আমি সব আপনাকে বিশ্বাস করে বলব। তবে যেন আমার কথা সত্য বলে ধরে নেয়া হয় এবং আমি যাদের সঙ্গে মিশতাম তাদের যেন অযথা কোনও শাস্তি দেওয়া না হয়।
প্রথম থেকে অর্থাৎ পাইলেদস-এর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে যা যা হয়েছিল, যা যা আমি করেছিলাম, বা লিখেছিলাম সব বললাম স্লিদেলকে, গ্রেচেনের কথাও বললাম। বলে মনে ব্যথা পেলাম দারুণ। ভাবলাম এ সব না বললেই ভাল হতো। আমার কোন ক্ষতি না হলেও তাদের ক্ষতি হবে হয়ত। যাই হোক, আমার চোখে জল দেখে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে গেলেন স্লিদেল।
স্লিদেল চলে গেলে আমি মেঝের উপর শুয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমার বোন এসে একসময় সান্ত্বনা দিল আমায়। বলল, কোনও ভয় নেই। বলল, নিচেতে বাবার কাছে। আর একজন দাঁড়িয়েছিল। স্লিদেল গিয়ে তারে সব বলতে তারা সন্তুষ্ট হলো। সবাই হাসাহাসি করতে লাগল। সবাই বলল, ব্যাপারটা এমন কিছু নয়।
তবু আমি আমার বন্ধুদের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে রইলাম। যারা একদিন আমায় বিভিন্নভাবে আনন্দ দান করেছে, সঙ্গ দান করেছ, তাদের জন্য দুঃখ হতে লাগল। আমার। আমি বাড়ির মধ্যে স্বেচ্ছানির্বাসন গ্রহণ করলাম। সারা দিনরাত বাড়ির মধ্যেই ভেবে ভেবে কাটাতে লাগলাম।
পরদিন বাবা আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু আমি গেলাম না। দিনকতকের মধ্যেই আমার অসুখ করে গেল। ডাক্তার ডাকতে হলো। অসুখের মধ্যেই আমার বন্ধুদের ভাগ্য সম্বন্ধে স্লিদেলের কাছে জানতে চাইলাম। অবশেষে আমাকে জানানো হলো আমার বন্ধুদের কারও কিছুই হয়নি। গ্ৰেচেন শহর থেকে গ্রামে চলে গেছে। তবে আমার মনে হলো, গ্রেচেন নিজে থেকে যায়নি। তাকে হয়ত আমার । জন্যই যেতে বাধ্য করা হয়েছে। আর একথা ভাবতে গিয়ে অসুস্থ শরীরেই দারুন কষ্ট পেলাম মনে। আমার মনে হলো পাইলেদস অথবা গ্ৰেচেন হয়ত চিঠি লিখেছিল আমায় । কিন্তু সে চিঠি আমাকে দেওয়া হয়নি।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আমার দেখাশোনার জন্য একজন লোক নিযুক্ত করা হলো। ভদ্রলোক বেশ অমায়িক লোক। আর আগে আমার বাবার বন্ধুর এক ছেলেকে পড়াতেন। সেই ছেলেটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেছে। ঠিক হলো, ভদ্রলোক আমার পাশের ঘরে থাকবেন এবং আমার সঙ্গ ও সান্ত্বনা দান করে সাহায্য করবেন আমার আরোগ্য লাভে। মোটামুটি ভদ্রলোককে আমার ভালোই লাগল।
কথা বলে জানলাম উনি আমার সবকিছুই শুনেছেন। আমি তাকে একদিন কথায় কথায় ঘোচেনের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। উনি বললেন, গ্রেনেচ খুব ভালো মেয়ে। তদন্তকারীদের সামনে গ্ৰেচেন খুব ভালো সাক্ষ্য দিয়েছে। আমি তখন জিজ্ঞাসা করলাম, আমার সম্বন্ধে কি বলেছে? উনি তখন উত্তর করলেন, আপত্তিকর কিছুই বলেনি; বরং খুব ভালো কথা বলেছে। তদন্তকারীরা তার আচরণে মুগ্ধ। গ্রেনে বলেছে, তুমি নাকি ছেলেমানুষ। তোমাকে ও ভাই-এর মতো স্নেহ করত। তুমি যাতে কুসঙ্গে না মেশো বা কারও প্ররোচনায় বিপথে না যাও তার জন্য ও সাবধান করে দিত তোমায়। এখন সে গ্রামে চলে গেছে। তোমাদের বন্ধুদের কোনও ক্ষতি হয়নি।