হোটেলে গিয়ে আমি আমার লেখা পড়ে শোনালাম। আমি যেন গ্রেচেনকে লক্ষ্য করেই এ চিঠি লিখেছি। কিন্তু আসলে পাইলেদস-এর বন্ধু যে মেয়েটিকে ভালোবাসে সে ধনী ঘরের মেয়ে। সুতরাং কিছু অদল-বদল করতে হলো। গ্ৰেচেন কাছ থেকে সব শুনছিল। একসময় আমার বন্ধু উঠে যেতেই গ্ৰেচেন নিজে থেকে আমার কাছে মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বলল, এসব কি করছেন আপনি? এটা অপরকে প্রতারণা করা হচ্ছে। এতে লাভ কি?
আমি বললাম, আসলে ব্যাপারটা মজার। নির্দোষ আমোদ।
গ্ৰেচেন বলল, এটা একটা মজার ব্যাপার নিশ্চয়, কিন্তু নির্দোষ নয় মোটেই। আমি দেখেছি এর মধ্য দিয়ে অনেক যুবক নিজেদের সর্বনাশ ডেকে এনেছে।
আমি বললাম, এখন কি করব! চিঠিটা লেখা হয়ে গেছে। এখন শুধু কিছু সংশোধন করা দরকার।
গ্ৰেচেন বলল, থাক, সংশোধন করতে হবে না। পকেটে রেখে দাও। আমি একজন গরিব ঘরের মেয়ে। আমাকে ওরা প্রথমে চিঠিটা নকল করতে বলেছিল। আমি রাজি হইনি। আর তুমি ধনী ঘরের পুরুষ ছেলে হয়ে জেনেশুনে এমন কাজ করছ যাতে কোনও ভালো হবে না, বরং তার থেকে অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে।
গেচেনের এই সব কথায় তাকে আরও ভালো লেগে গেল আমার। আবেগে আত্মহারা হয়ে পড়লাম আমি। আমি বললাম, কি হবে টাকা-পয়সা বা ধন-ঐশ্বর্যে যদি আমি আমার আকাক্ষিত বস্তুকে না পাই।
এমন সময় আমার হাত থেকে লেখা চিঠিটা নিয়ে শান্তভাবে পড়তে লাগল। পড়ে আপনার মনে বলল গ্রেচেন, চমৎকার লাগছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এত ভালো লেখা কোনও ভালো বা সৎ উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা হচ্ছে না।
গ্ৰেচেন চিঠিটা আমার হাতে দিলে আমি বললাম, কোনও প্রেমিকার কাছ থেকে এই ধরনের চিঠি পাওয়া কতই না ভাগ্যের কথা। আচ্ছা, যদি কেউ তোমাকে ভালোবেসে শ্রদ্ধার সঙ্গে এই ধরনের লেখা লেখে তাহলে তুমি কি করবে?
আমি কাগজটা তার দিকে এগিয়ে দিতেই গ্রেচেন মৃদু হেসে কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে কলম দিয়ে কাগজটাতে তার সই করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আমি আবেগে আত্মহারা হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম। কিন্তু গ্রেচেন বলল, না, আলিঙ্গন বা চুম্বন নয়, পারলে পরস্পরকে আমরা ভালোবেসে যাব।
কাগজটা পকেটে ভরে রেখে বললাম, এ আর কেউ পাবে না। ব্যাপাটার এইখানেই ইতি। তুমি আমাকে মুক্ত করলে অবাঞ্ছিত এই ব্যাপারটা থেকে।
গ্ৰেচেন বলল, তোমার বন্ধুরা না আসতেই চলে যাও।
আমার যেতে মন সরছিল না। তবু যেতে হবে। গ্ৰেচেন আমার দুটো হাতের মধ্যে হাত দিয়ে মৃদু চাপ দিল। আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। জল এল চোখে। আমি তার হাত দুটো তুলে নিয়ে আমার মুখের উপর একবার চেপে ধরেই ছেড়ে দিয়ে চলে গেলাম।
প্রথম প্রেমের আবেগের সঙ্গে যেন এক আধ্যাত্মিক ব্যাকুলতা জড়িয়ে থাকে। গ্ৰেচেনের কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সৌন্দর্যের এক নূতন জগৎ খুলে গেল আমার সামনে। আমার জীবন-যৌবন যেন হঠাৎ অর্থময় হয়ে উঠল। আমি তার সই করা সেই কাগজটা বার করে পকেট থেকে বার করে সেটাকে চুম্বন করতে লাগলাম। বুকের উপর চেপে ধরলাম।
পরের রবিবার আবার আমি নিজের থেকে পুরনো বন্ধুদের আড্ডায় গেলাম। চিঠিটা ঠিক করে দিইনি বলে তারা মোটেই রাগ করেনি আমার উপর। বরং তারা নিজেরা যেচেই বলল, তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। এই ধরনের কাজ আর করবে না। এর থেকে আমি যদি কিছু বিয়ের ও মৃত্যুর উপর কবিতা লিখে দিই, তাহলে তার থেকে তারা উপকৃত হবে এবং আমিও যা পাব তাতে হোটেলের বন্ধুদের খাওয়ার খরচটা হয়ে যাবে।
তারা সবাই ছিল স্বল্পবিত্ত ঘরের ছেলে। সব দিন হোটেলে কিছু খাবার পয়সা থাকে না। তাদের অবস্থার কথা বিবেচনা করে আমি রাজি হয়ে গেলাম। তারা পরদিন সন্ধ্যায় আমাকে হোটেলে নিমন্ত্রণ করল। গ্ৰেচেনও নাকি তাদের সঙ্গে খাবে। গ্ৰেচেনের কথা শুনে উল্লসিত হয়ে আমি পরের দিন সন্ধ্যার জন্য ব্যাকুলভাবে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।
পরের দিন সন্ধ্যা হতেই হোটেলে হাজির হলাম। গ্ৰেচেনকে দেখে খুশি হলাম। বন্ধুরা সব হইহুল্লোড় করতে লাগল। গ্রেচেন একপাশে চুপ করে বসে রইল। আমার চোখ সব সময়েই প্রায় নিবদ্ধ ছিল গ্রেচেনের উপর। ঠিক হলো, তার বন্ধুরা একে একে তাদের জীবনের লক্ষ্য কি তা বলে যাবে। পাইলেদস-এর পর আমি বললাম।
আমার প্রতি আচরণের ব্যাপারে গ্রেচেন একটা সঙ্গতি আর রীতি মেনে চলত। আমি যখন কিছু লিখতাম বা পড়তাম তখন সে আমার কাছে ঘন হয়ে বসে আমার পিঠের উপর হাত রেখে তা দেখত। কিন্তু আমি যদি কখনও তার পিঠে বা কাঁধের উপর হাত রাখার চেষ্টা করতাম তাহলে সে সরে যেত। গ্ৰেচেনের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া শক্ত ছিল। সে কখনও চরকা কাটার কাজ করত, কখনও বা সেলাই-এর কাজ করত। কখন কোথায় কি কাজ করত বোঝাই যেত না। একদিন আমার লোকের জন্য একটা নামকরা বড় ফুলের দোকান থেকে ফুল আনতে গিয়ে দেখি ঘেঁচেন অন্য পোশাক পরে সেই ফুলের দোকানে অস্থায়ীভাবে কোনও এক কর্মচারীর পদ পূরণ করছে। আমাকে দেখতে পেয়ে গ্ৰেচেন ইশারা করে আমাদের পরিচয়ের কথা প্রকাশ করতে নিষেধ করল।
পরে গ্ৰেচেনকে সে কথা জিজ্ঞেস করায় সে বলল, তোমরা সেদিন আমার জীবনের লক্ষ্যের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলে নারীদের উচিত ভদ্র কাজের মধ্য দিয়ে তাদের অবসর সময় কাটানো। আমি সেদিন দেখলাম একটি ফুলের দোকানে একদিনের জন্য একটি কাজ খালি আছে। তাই ঢুকে গেলাম।