ভন ম্যালাপার্ট নামে এক ধনীও রেনেকার মতো একা একা থাকতেন। কিন্তু পরে তাঁর সঙ্গে রেনেকার ভাব করিয়ে দিই। ম্যালাপার্টের ফুলবাগানে বসন্তের ফুলের ছাড়াছড়ি হতো। যেখানে-সেখানে রেনেককে পাঠিয়ে দিতাম কৌশলে।
এরপর মনে পড়ে হাৎ হুয়েসজেনের কথা। ধর্মের দিক থেকে তিনি সংস্কারপন্থী ছিলেন না বলে কোনও সরকারি পদ পাননি। কিন্তু কৃত আইনজীবী হিসাবে নাম করেছিলেন। হুয়েসজেনের মাথায় টাক ছিল। সব সময় মুখে হাসি লেগেই থাকত। গণিতে তার জ্ঞান ভালো ছিল এবং তিনি নিজের বুদ্ধিতে সব এক ঘড়ি তৈরি করেন যা ঘণ্টা-মিনিট ছাড়া সূর্য-চন্দ্রের গতিবিধি বলে দিতে পারত। কিন্তু হুয়েসজেন আইনবিদ্যাকেই সবচেয়ে ভালোবাসতেন এবং মনে করতেন প্রত্যেক ছাত্রেরই আইন পড়া উচিত। কারণ এই আইনের দ্বারা নিপীড়িত উৎপীড়ত মানুষের উপকার করা যায় সবচেয়ে বেশি।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
আমার শিক্ষা, স্বভাব, গৃহ, পরিবেশ এমনই ছিল যে আমি সমাজের নিচুতলার লোকদের সঙ্গে মিশতে পারতাম না। কখনও কোনও ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠত না তাদের সঙ্গে। বিশেষ করে মিস্ত্রী বা কারিগরদের আমি দেখতে পারতাম না। কোনও অসাধারণ বা বিপজ্জনক কাজের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে যাবার সাহস ছিল আমার। কিন্তু সে কাজ সম্পন্ন করার মতো উপযুক্ত কৌশল ও কর্মশক্তি ছিল না।
এই সময় অপত্যাশিতভাবে আমি একটা জটিল ঘটনাজালের মধ্যে জড়িয়ে পড়ি। আমি বলি পাইলেদস নামে আমার এক বন্ধু ছিল। একদিন ফোর্ট গ্যালাসের কাছে পাইলেদস-এর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল আমার। তার সঙ্গে তার দু-একজন বন্ধুও ছিল। দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ের পরই সে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল, আমি তোমার কবিতা আমার সঙ্গীদের কাছে পড়ে শুনিয়েছিলাম। তারা কেউ বিশ্বাস করতেই চায় না যে এটা তোমার লেখা।
আমি বললাম, কবিতা সম্বন্ধে যার যা খুশি বলতে পারে। এতে বলার কিছু নেই। ছেড়ে দাও।
পাইলেদস কিন্তু অত সহজে ছাড়ল না। সে বলল, আমার বন্ধুদের বক্তব্য, এই ধরনের কবিতা লেখার জন্য যে ধরনের শিক্ষাদীক্ষা থাকা দরকার তা তোমার নেই। আমি কোনও উত্তরই দিলাম না। তখন পাইলেদস তার সঙ্গীদের বলল, ঠিক আছে, তোমরা ওকে কোনও বিষয়বস্তু দাও। ও সঙ্গে সঙ্গে এইখানে কবিতা লিখে দেবে।
আমি তাতে রাজি হলাম। তখন ঠিক হলো আমাকে একটি প্রেমপত্র ছন্দোবদ্ধ কবিতায় লিখে দিতে হবে। ধরে নিতে হবে কোনও এক যুবতী তার প্রেমিককে তার মনের কথা জানাচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে একটা বেঞ্চের উপর বসে পড়লাম। ওরা আমাকে সাদা কাগজ দিল। ওরা কাছাকাছি থেকে আমার উপর নজর রাখতে লাগল। আমি লিখতে শুরু করলাম। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম যেন কোনও তরুণী যুবতী আমাকে ভালোবাসে এবং যে আমাকে তার মনের গভীর গোপন কথাগুলো জানাচ্ছে।
কবিতাটি শেষ হলে পাইলেদস ও তার বন্ধুরা একবাক্যে প্রশংসা করল আমার। তারা আমাকে বিশেষ ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল। বলে গেল শীঘ্রই আবার দেখা হবে।
সত্যিই দেখা হলো। গ্রামাঞ্চলে এক প্রমোদভ্রমণের ব্যবস্থা হলো। পাইলেদস তার একদল বন্ধু নিয়ে হাজির হলো। তারা সবাই বলল, আমার চিঠিটা নিয়ে একটা বেশ মজার ব্যাপার করেছে তারা। তাদের এক বন্ধুর ধারণা মাত্র একদিনের পরিচয়েই এক যুবতী প্রেমে পড়েছে। ওরা তাই আমার সেই ছন্দোবদ্ধ প্রেমপত্রটি একটু সম্পাদনা করে। অন্য হাতে লিখিয়ে সেই বন্ধুর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছে। সে চিঠি পেয়ে বন্ধু ভাবছে তার প্রেমিকাই সে চিঠি লিখেছে। এবার সে চিঠির জবাব দিতে চায়। কিন্তু সে ক্ষমতা তার নেই। তাই আমার সাহায্য একান্ত দরকার।
খেলাচ্ছলে ছলনা ও প্রতারণা করে ছেলেবেলায় আমরা অনেক আনন্দ পেয়েছি। কিন্তু এখন দেখলাম সব বয়সের মানুষই এ ধরনের ছলনায় আনন্দ পায়। যাই হোক, আমি মত দিলাম। তার চিঠির উপাদান আমাকে দিয়ে দিল। আমি লিখে দিলাম।
এরপর একদিন সন্ধ্যার সময় কোনও এক হোটেলের এক ভোজসভায় নিয়ন্ত্রণ পেলাম আমি। গিয়ে দেখলাম পাইলেদস-এর সেই প্রেমিক বন্ধুটি এই ভোজসভার ব্যয়ভার বহন করছে। আমি গিয়ে বসলাম। খেলাম। কিন্তু ওদের সঙ্গ আর আমার ভালো লাগছিল না। আমি প্রতিজ্ঞা করলাম এ ধরনের লেখা আর লিখব না। অকারণে একটি মানুষকে ছলনার দ্বারা প্রতারিত করে বিগত সন্ধ্যাটা আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর হয়ে উঠল। কিন্তু হঠাৎ একটা মিষ্টি ঘটনা ঘটে আমার মনটাকে অন্যদিকে নিয়ে গেল।
খাবার পর আমাদের কিছু মদের দরকার ছিল। আমাদের মধ্যে একজন হোটেলের পরিচারিকাকে ডাকল। কিন্তু পরিচারিকার বদলে এল পরমা সুন্দরী একটি মেয়ে। নাম তার গ্ৰেচেন। তার মুখ-চোখ অপরূপ লাবণ্য। সুন্দর সুগঠিত দেহ। আঁটসাঁট পোশাক। একবার তাকালে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। আমাদের অনুরোধে আমাদের কাছে। বসে একপাত্র মদ পান করল ঘেঁচেন।
সেদিন সন্ধ্যায় সেইখানেই ব্যাপারটার ইতি ঘটলেও আমার মনের মধ্যে সব সময় সব জায়গায় গ্রেচেনের ছবিটা আনাগোনা করতে লাগল। যেহেতু তার বাড়িতে যাওয়ার কোনও অজুহাত ছিল না আমার সেই হেতু একটি চার্চে গেলাম তার দেখা পাবার আশায়। দেখা পেলাম। কিন্তু তার কাছে গিয়ে আলাপ করতে পারলাম না।
সেদিন না পারলেও আবার একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। পাইলেদস আবার আমাকে ডাকল সেই হোটেলের এক সান্ধ্য ভোজসভায়। তার বন্ধুর যে প্রেমপত্র আমি লিখে দিয়েছিলাম সেটা তারা মিথ্যা করে বলেছে, নির্দিষ্ট ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়েছে। এবার মেয়ের তরফ থেকে উত্তর দেবার পালা। সেই উত্তর আমায় লিখতে হবে। এসব লেখা আর লিখতাম না আমি। কিন্তু হোটেলে গেলে গেচেনকে দেখতে পাব বলে রাজি হয়ে গেলাম।