আমার বাবা বলতেন কোনও কাজ শুরু করলে তা যেমন করেই হোক শেষ করতে হবে। কাজের পথে যত বাধা, বিপত্তি, দুঃখকষ্ট আসুক না কেন তা শেষ করতেই হবে। তার মতে মানুষের জীবনে একমাত্র লক্ষ্য হবে পূর্ণতা, আর তার একমাত্র গুণ হবে অধ্যবসায়। তাই দীর্ঘ দিনের শ্রম ও সাধনায় এ কাজ আমি সম্পন্ন করেছি তা দেখে প্রীত হলেন বাবা।
কিন্তু আমি যাই করি বা যত ভাষাই শিখি, লেখা বা ছবি আঁকায় যত কৃতিত্বই দেখাই তার মূল লক্ষ্য হতে বিচ্যুত হননি বাবা। তিনি একবার যা বলেন তা ভোলেন না। একবার যা লক্ষ্য হিসাবে স্থির করেন তার থেকে সরেন না। তিনি চেয়েছিলেন আমাকে আইন পড়িয়ে তাঁর আরদ্ধ কাজ সম্পন্ন করবেন। তাই তিনি একদিন হঠাৎ আমাকে একটি হালের আইনের বই দিলেন পড়তে। যদিও আমার কাছে বইখানি খুবই কঠিন ঠেকছিল তবু বাবার হুকুম তা পড়ে শেষ করতেই হবে।
একদিন আমাদের শহরে নেহাৎ কৌতূহলের বশে ইহুদিদের বস্তি দেখতে যাই। তারা যে ঘিঞ্জি নোংরা বস্তিতে থাকত তা দেখে দুঃখ হতো আমার। ঈশ্বরপ্রেরিত যে জাতির কথা বাইবেলে ফলাও করে পড়েছি সেই জাতির অবশিষ্টাংশ এরা। এদের এই শোচনীয় অবস্থা দেখে সত্যিই কষ্ট হয় আমার। আমি আমার অবসর সময়ে মাঝে মাঝে সেই বস্তিতে যেতাম। তাদের জীবনযাত্রা লক্ষ্য করতাম। অনেক উৎসবে যোগ দিতাম। খ্রিস্টান হয়েও তাদের সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহারে মুগ্ধ হতাম আমি।
আমার ইচ্ছা না থাকলেও যৌবনে পা দিয়ে আমাদের দেশের প্রথা অনুসারে ঘোড়ায় চাপা ও ফেন্সিং খেলা শিখতে হলে আমায়। আমাদের শহরে তখন দুজন ফেন্সিং খেলোয়াড় এ খেলা শেখাতেন। একজন জার্মান ও আর একজন ফরাসি ভদ্রলোক। আমি ফরাসি ভদ্রলোকের কাছেই এ খেলা শিখতে থাকি। তবে ঘোড়ায় চাপা বাপারটা আমার মোটেই ভালো লাগত না। পরে অবশ্য আমি খুব ভালো ঘোড়সওয়ার হয়ে উঠি এবং একনাগাড়ে কয়েকদিন ঘোড়ার পিছে চেপে থাকতে পারি অক্লান্তভাবে।
আমি বড় হয়েছি দেখে বাবা আমাকে এই সময় তার ব্যবসায় সাহায্য করতে বলেন। আমাদের যে কারখানায় অনেক লোক কাজ করত এবং বাবাকে যেখানে দেখাশোনা করতে হতো দীর্ঘ সময় ধরে, আমাকে সেখানে যেতে বললেন বাবা। কাজের তদারক করতে বললেন। কর্মীদের উপর নজর রাখতে বললেন। এইভাবে কর্মস্থলে গিয়ে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্কটিকে ভালোভাবে দেখতে পাই। আর তা থেকেই উদ্ভুত এক সাম্যবোধ জাগে আমার মনে। উচ্চ, অভিজাত ও নিম্ন সকলের মধ্যে কোথায় প্রকৃত পার্থক্য তা বুঝতে চাই আমি। সব মানুষ সমান হোক তা আমি হয়ত চাইনি। আমি চেয়েছিলাম মানবজীবনের বিভিন্ন অবস্থার মধ্যে অন্তত সমতা বিরাজ করুক, কারণ শ্রেণী নির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যেই আছে অস্তিত্বের সংরক্ষণ প্রচেষ্টা, বাঁচার এক অপরিহার্য তাগিদ।
এই সময় ভন ওলেনস্লেগার আমাদের পরিবারের খুব প্রিয় হয়ে ওঠেন। ওলেনম্নেগারের নাটকে বেশ জ্ঞান ছিল। তিনি যুবকদের নিয়ে বেশ আমোদ-প্রমাদ করতে পারতেন। তাঁর নাটক করার খুব শখ ছিল। তাঁর নির্দেশনায় আমরা স্লেগারের ক্যানিয়ুট মঞ্চস্থ করি। এতে আমি আমার বোন ও ছোট ভাই তিনজনেই তিনটি ভূমিকায় অভিনয় করি। এরপর রেসিনের লেখা ট্র্যাজেডি ব্রিটানিকাশও মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকে নিরোর ভূমিকায় অভিনয় করি। আমার বোন নেয় এগ্রিপিয়ার ভূমিকা। এইভাবে ভন ওলেনম্নেগার এক রীতিমতো নাট্যপ্রীতি জাগিয়ে তোলেন আমার প্রথম যৌবনে।
১৭৬৩ সালের প্রথম বসন্তে একদিন এক জাতীয় উৎসবে মেতে ওঠে আমাদের শহর। কারণ ঐ দিন হুবার্তসবার্গ সন্ধি সম্পাদিত হয়। কিন্তু চারদিকের আনন্দোৎসবের মাঝে আমার কেবলি মনে পড়তে থাকে ভন রেনেকের কথা। আপন কন্যার সঙ্গে মামলায় হেরে গিয়ে স্বেচ্ছাকৃত এক প্রায়ান্ধকার কারাজীবন যাপন করে চলেছেন তিনি। তাঁদের মুখে আমি কোনওদিন বিন্দুমাত্রও হাসি ফুটে উঠতে দেখিনি। একবার তার পরিবারের বন্ধুস্থানীয় একটি লোকের সঙ্গে তাঁর মেয়ে পালিয়ে যায়। এটা মনঃপুত না হওয়ায় তিনি তাদের সন্ধান করেন। সন্ধান পেয়ে মামলা করেন। কিন্তু তাঁর প্রাপ্তবয়স্কা মেয়ে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় মামলায় হেরে যান রেনেক। হেরে গিয়ে তার বাড়ির একতলায় এক অন্ধকার ঘরে আশ্রয় নেন। সে ঘর থেকে বিশেষ বার হতেন না। সে ঘরের দেওয়াল চুনকাম করা হয় না কখনও। কিন্তু রেনেক আমাকে বড় ভালোবাসতেন এবং তার ছোট ছেলেকে আমার সঙ্গে মিশতে বলতেন।
আমি তাঁর কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর খিটখিটে মেজাজ অনেকটা শান্ত ও নরম হতো। তাঁর বাড়িতে গেলে খাওয়া-দওয়া ভালোই হতো। তিনি অতিথিবৎসল ছিলেন। কিন্তু তার একটা স্টোভ ছিল। সেই স্টোভটা জ্বালতে গেলেই ধোয়া হতো আর তাতে অতিথিদের কষ্ট হতো। একদিন এক অতিথি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রেনেক বলেন মানুষকে যে সব অশুভ শক্তি কষ্ট দেয় তারা যদি ঈশ্বরের কাছে যেত তাহলে ভালো হতো। একবার তার মেয়ে তাঁর প্রথম ছেলেকে নিয়ে দেখা করতে আসে। জামাই ভয়ে আসেনি। কিন্তু যে মেয়েকে নিয়ে এত কাণ্ড, এত মামলা-মোকদ্দমা, সে মেয়ের আর মুখদর্শন করবেন না তিনি। আমার প্রতি রেনেকের কিছুটা দুর্বলতা ছিল। তাঁর অনমনীয় মনকে নমনীয় করার জন্য আমাকে ডাকা হলো। অবশেষে অনেক করে মেয়ের সঙ্গে দেখা করে একবার নাতির মুখ দেখার জন্য রাজি করলাম রেনেককে। যে। রেনেক সেই অন্ধকার ঘরখানা ছেড়ে, তাঁর স্বেচ্ছানির্বাসনের সেই জগৎ ছেড়ে কোথাও বার হতেন না, সেই রেনেককে নিয়ে প্রতি রবিবার বিকালে বেড়াতে বেরোতাম। তিনি গোলাপী রং ভালো না বাসলেও তাঁকে গোলাপী ফুল ভালোবাসতে শিখিয়েছিলাম।