‘অফিসারকে জিজ্ঞাস করতে যাবেন আপনার জন্য কী করতে পারি?” ঠিক তখনই জাহাজ ভয়াবহভাবে ঝাঁকি খেল। অ্যালার্ম বাজতেই ব্রিজে যারা ছিল চিৎকার করে উঠল সবাই।
কী হচ্ছে? জানতে চাইলেন অফিসার।
“আমি জানি না’। এই কথা উচ্চারণ করতে ক্যাপ্টেন খুব ভয় পান কিন্তু তবুও তাকে উচ্চারণ করতেই হলো।
‘আমরা কি কোনো কিছুকে ধাক্কা দিয়েছি?’
ইস্ততত করলেন হাসিমোটো। ধাক্কা দেয়ার মতো কিছু নেই। আমরা যেখানে আছি এখানকার গভীরতা প্রায় ৯ হাজার ফিট।’ একজন জুনিয়র অফিসারকে এগিয়ে আসতে দেখে থামলেন ক্যাপ্টেন। ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে জুনিয়র অফিসার ভয়াবহ রিপোর্ট দিল তাঁকে। হাসিমোটো মাথা নেড়ে সংক্ষিপ্তভাবে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে আর্মি অফিসারের দিকে ফিরলেন। ‘দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি, যে-কোন খারাপ পরিস্থিতির জন্য আমাদেরকে এখন তৈরি হতে হবে। আপনি নীচে চলে যান। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেগুলো পালন করুন।
কী?
‘রিপোর্ট পেয়েছি, জাহাজের কাঠামোর মেরামতকৃত এক অংশ ফেটে গেছে। আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করব কিন্তু পাম্প কতটা পানি সরাতে পারবে সেটা এখুনি বলা যাচ্ছে না। যদি অবস্থা সুবিধের না হয় আমাদেরকে এই জাহাজ পরিত্যাক্ত ঘোষণা করতে হবে।’
অফিসারের চেহারা মরা মানুষের মতো সাদা হয়ে গেল। এই আবহাওয়ার মধ্যে?’ কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরের ঝড়ের দিকে তাকালেন তিনি।
‘সেটা আমরা খুব শীঘ্রই জানতে পারব। আশা করছি, ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ আমাদের নিয়ন্ত্রনে থাকবে। ক্যাপ্টেন অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলেন। এখন দয়া করে আমাকে আমার কাজ করতে দিন।’
মুখ হাঁড়ি করে মাথা নাড়লেন অফিসার। নীচে নামার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে পা দিয়েছেন কি দেননি এমন সময় আরেকটা বড় ঢেউ এসে জাহাজের বাম পাশে আঘাত করল।
হাসিমোটো তার ক্রুদেরকে সম্ভাব্য সবধরনের পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন। ওদিকে হেলমসম্যান জাহাজকে ঠিক পথে পরিচালনা করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জয় হলো সমদের। কালো ঢেউগুলো একের পর এক হামলে পড়তে লাগল জাহাজের ওপর। ব্রিজে থাকা শেষ লাইটাও অবশেষে নিভে গেল। ডেস্ট্রয়ারের ভারি স্টিলের কাঠামো এখন একটা নোঙ্গরে পরিণত হয়েছে। সাগরের তলদেশের দিকে ছুটছে সেটা। স্ত্রী ইউঁকি আর এক বছর বয়সী ছেলের কথা মনে পড়ল ক্যাপ্টেনের। ছেলেকে চোখের সামনে যুবক হয়ে ওঠা দেখা হলো না তার। খুব একটা সময়ও কাটাতে পারেননি ছেলের সাথে।
তবে তারচেয়ে বড় বিষয় ক্যাপ্টেনকে লজ্জা দিল। মিশনে ব্যর্থতা। নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য কাপুরুষের মতো চেষ্টা করার চেয়ে মিশনে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় জাহাজসহ বীরের মতো মৃত্যুবরণ করা অনেক ভাল।
তিন ঘণ্টা পর সাগর একদম শান্ত হয়ে গেল। ঝড় উত্তর দিকে সরে গেছে। তবে ইতিমধ্যে ৪০০ ফুট দীর্ঘ একটা জাহাজকে গিলে নিয়েছে সাগর। কোনো চিহ্ন পর্যন্ত রাখেনি। কোনামি-র এই যাত্রার কোনো রেকর্ড রাখা ছিল না, এর সাথে সঙ্গ দেয়ার জন্য ছিল না কোনো জাহাজও। এর ডুবে যাওয়ার কোনো অফিসিয়াল রেকর্ড থাকবে না। সবকিছু মুছে ফেলা হবে। গোপন যা কিছু ছিল ডেস্ট্রয়ার কোনামি সবকিছু নিয়ে সাগরের তলায় চলে গেছে।
মিত্রপক্ষের জাহাজ মাত্র চারজনকে উদ্ধার করতে পেরেছিল। বাকিদের ইহলীলা সাঙ্গ করছে ঝড় ও হাঙ্গররা। জাহাজের কমাণ্ডে থাকা ব্যক্তি জাপানিজ জাহাজ নিয়ে কোনো আগ্রহই দেখালেন না। স্বাভাবিক কোর্সের বাইরে এসে এই জলপথে জাহাজটা কী করছিল কিছুই জানতে চাইলেন না তিনি। উদ্ধারকৃত ব্যক্তিরাও চুপচাপ রইল। যুদ্ধে তাদের অংশ শেষ। মান-সম্মানের কিছু বাকি নেই এই চারজনের। তাদের বেঁচে যাওয়া মরণের চেয়েও খারাপ।
.
০৩.
গোয়াডালক্যানেল, সলোমন আইল্যান্ড, বর্তমান সময়
তিনটে ছোট ছোট নৌকো পাম গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে যেন সাগরের ঢেউয়ের ধাক্কায় ওগুলো হারিয়ে না যায়। নৌকোগুলোর চারিদিকে সমুদ্রের নীল ঘিরে রয়েছে। অবশ্য বিকেলের সূর্যের আলোতে পানিতে রূপোলী ছটা পড়েছে এখন। স্যাম ফারগো আর রেমি ফারগো একটা পাম গাছের ছায়ায় বসে আছে। পাম গাছের পাতাগুলো দুলছে হালকা বাতাসে। ম্যানিকিউর (হাতের নখ কাটা, পালিশকৃত) করা হাত তুলে সূর্যের আলো থেকে নিজের চোখ বাঁচিয়ে ডাইভারদের (যারা পানিতে ডুব দেয়, ডুবুরি) কার্যক্রম দেখছে ও। সমুদ্রপাড় থেকে ২৭০ ফুট দূরের পানিতে চতুর্থ একটা নৌকোর কাছে রয়েছে ডাইভাররা।
স্যাম নিজের হালকা বাদামি চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে ওর স্ত্রীর দিকে তাকাল। রেমির মুখের মেকআপ বাসি হয়ে গেলেও লালচে দীর্ঘ চুল আর মসৃণ তুক ঠিকই সূর্যের আলোতে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। জীবন সঙ্গীনির অ্যাথলেটিক দেহের দিকে তাকাল স্যাম, এক হাত বাড়িয়ে দিল স্ত্রীর পানে। হেসে ওর হাতটা ধরল রেমি। প্রত্নতাত্ত্বিক গুপ্তধনের জন্য অগণিত অভিযানে বেরিয়েছে দু’জন। এতগুলো দিন কেটে যাওয়ার পরও ওরা এখনও একসাথে আছে। যেটা ওদের দুজনের মধ্যকার শক্তিশালী বন্ধনের পরিচয় দেয়।
‘এই বিচে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে, স্যাম,’ চোখ বন্ধ করে বলল রেমি।
‘ভালই তো। যাও অনুমতি দিলাম। এই বিচ তোমার!’ স্যাম সম্মতি দিল।