ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছেন ডেস্ট্রয়ারের ক্যাপ্টেন হাসিমোটো। সাগরের ঢেউগুলোতে তিনি কোনো ছন্দ খুঁজে পাচ্ছেন না। বিক্ষিপ্ত ঢেউগুলোর সাথে মোকাবেলা করে কোর্সে থাকার জন্য লড়ছে কোনামি। সাগরের এই উত্তাল অংশ এড়িয়ে যেতে পারতেন ক্যাপ্টেন কিন্তু গেলেন না। তাকে কড়া শিডিউল মানতে হবে। কোথাও কোনো কারণে সময় নষ্ট করা চলবে না। কোনামি উত্তর দিকে এগোচ্ছে, গন্তব্য- জাপান।
এই ডেস্ট্রয়ারকে একটা টপ সিক্রেট মিশন দিয়ে রাতের অন্ধকারে পাঠানো হয়েছে। দ্বীপ থেকে সৈন্য সরানোর পাশাপাশি সাথে একজন অফিসারকেও জাহাজে তুলতে হয়েছে। এই অফিসার নাকি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই অফিসার ও তার এলিট বাহিনিও কোনামি-তে অবস্থান করছে এখন। তবে অফিসারের বাকি সৈন্যরা তাদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করার জন্য গোয়াডালক্যানেল থেকে বুগেইনভিল আইল্যাণ্ডে যাত্রা করেছে।
হাসিমোটো অবশ্য জানেন না এই অফিসার কী এমন মহামান্য ব্যক্তি যে তাঁর যাতায়াতের জন্য একটা আস্ত ডেস্ট্রয়ার প্রয়োজন হলো! বিষয়টা নিয়ে ক্যাপ্টেনের কোনো মাথাব্যথা নেই। নির্দেশ পালন করাই তার কাজ। যদিও অধিকাংশ সময় নির্দেশগুলোকে স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে অদ্ভুত লাগে। টোকিও থেকে এই জাপানিজ ডেস্ট্রয়ারের কমাণ্ডার হিসেবে তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব পালন করাটাই হাসিমোটোর কাছে মুখ্য বিষয়। তার এখন একটাই চিন্তা দায়িত্ব পালন করে ভালয় ভালয় কখন নিস্তার পাবে।
হঠাৎ কোত্থেকে যেন একটা ঢেউ উদয় হয়ে জাহাজের পেছনের অংশে সজোরে আঘাত হানল। কেঁপে উঠল পুরো ডেস্ট্রয়ার। হাসিমোটো নিজের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য কনসোল আকড়ে ধরলেন। ভ্রু কুঁচকে ঝড়ো আবহাওয়ার দিকে তাকালেন তিনি। অবস্থা ভাল নয়। যে নির্দেশ দিতে তিনি ঘৃণা করেন সেটাই দিলেন এখন।
‘গতি দশ নটে নামাও, মৃদু গর্জন করলেন ক্যাপ্টেন’। কথা বলতে বলতে তার চেহারায় চিন্তার রেখা গভীরভাবে ফুটে উঠল।
‘জো হুকুম, স্যার’। হেলমসৃম্যান (জাহাজের কাণ্ডারি) সাড়া দিল।
তারা দুজনই দেখতে পেলেন জাহাজের সামনে পানির বিশাল ঢেউ তৈরি হয়ে এগিয়ে আসছে। দেখতে দেখতে জাহাজের সামনের অংশে আছড়ে পড়ল ঢেউ। পুরো ঢেউ জাহাজের উপর চড়াও হতেই ডানদিকে বিপদজনকভাবে জাহাজ হেলে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই কোনামি তার ভারসাম্য ফিরে পেয়ে আবার এগোতে শুরু করল বিক্ষুব্ধ সাগরের বুক চিড়ে।
সাগরের এমন বৈরি রূপ ক্যাপ্টেন হাসিমোটোর কাছে নতুন নয়। এরআগে অনেক জঘন্য ও বিপদসংকুল আবহাওয়ার ভেতর দিয়েও তিনি তার জাহাজকে বের করে নিতে সফল হয়েছেন। দু’দুটো টাইফুন মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা আছে তার। এছাড়াও অন্যান্য দুর্যোগ তো আছেই। সবকিছুকে হার মানিয়ে বেঁচে ফিরেছেন তিনি। কিন্তু আজ রাতের বিষয়টা ভিন্ন। আজকের ঝড় তার বিগত দিনের সকল দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে হার মানিয়ে দিতে চাচ্ছে।
সকাল হলে বিপদ আরও বাড়বে। হয়তো কোনো প্লেন তার ডেস্ট্রয়ারের দিকে টর্পেডো ছুঁড়ে মারবে। নিরাপত্তার চাদর হিসেবে কাজ করছে রাতের অন্ধকার। দিনের আলোকে সাধারণত বন্ধু ভাবা হলেও ক্যাপ্টেন হাসিমোটোর সাক্ষাৎ যম সেটা। ক্যাপ্টেন হিসেবে অনেক অভিজ্ঞতা থাকলেও যুদ্ধক্ষেত্রে জাহাজ চালানোর ব্যাপারে হাসিমোটোর অভিজ্ঞতা অল্পই। দিনের আলো ফুটলে হয়তো তার যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা আর সমৃদ্ধ হবার সুযোগ পাবে না।
হাসিমোটো জানেন, বিভিন্ন দিক থেকে তিনি অন্যান্যদের তুলনায় একজন দক্ষ ক্যাপ্টেন কিন্তু আজ রাতে সেই খ্যাতির কোনো মূল্য নেই। সাগরের বৈরি বাতাস আর দৈতাকার ঢেউ কারো খ্যাতির পরোয়া করে না। আচ্ছা, জাপান যদি যুদ্ধে হেরে যায় তাহলে কি হাসিমোটোর চাকরি চলে যাবে? যদি তা-ই হয়, তাহলে মৃত্যুর আগপর্যন্ত নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে বীরের মতো মরতে চান হাসিমোটো। নিজের পদমর্যাদা ও পরিবারের নাম যেন সমুন্নত থাকে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি আছে তার। তিনি সহকর্মী ক্যাপ্টেনদের মতো শক্ত হাতে কোর্স অনুসরণ করবেন। সামুরাইরা কখনও রণে ভঙ্গ দেয় না।
যে আর্মি অফিসারকে তারা দ্বীপ থেকে উদ্ধার করে জাহাজে তুলেছেন নীচ থেকে সেই অফিসার ব্রিজে উঠে এলেন। তার চেহারা পাংশুবর্ণ ও বিবর্ণ হলেও হাঁটা-চলায় এখনও মিলিটারি ভাব বজায় আছে। হাসিমোটোর দিকে মাথা নেড়ে মাপা দৃষ্টি মেলে সাগরের দিকে তাকালেন অফিসার।
‘আমাদের গতি কমেছে?’ অফিসারের কর্কশ কণ্ঠ শুনে মনে হলো গলায় শিরিস কাগজ ডলা হয়েছে।
“হ্যাঁ। দ্রুত এগোতে গিয়ে ডুবে মরার চেয়ে সাবধানে এগোনো ভাল।
আপত্তিসূচক ঘোঘোত করলেন অফিসার। আলোকিত ইন্সট্রুমেন্টগুলো পর্যবেক্ষণ করে বললেন, রাডারে কিছু দেখা যাচ্ছে নাকি?
মাথা নাড়লেন হাসিমোটা। জাহাজের সামনে আরেকটা ঢেউ হামলে পড়তে দেখে নিজেকে তৈরি রাখলেন ক্যাপ্টেন। আড়চোখে আর্মি অফিসারের চেহারা দেখে নিলেন হাসিমোটো। অফিসারের চেহারায় দৃঢ়-সংকল্প আর ক্লান্তি ছাড়াও আর একটা কী যেন আছে। চোখের গভীরে কিছু একটা আছে। সেই ‘কিছু একটা ভাল কিছু নয়। তাই হাসিমোটোর দুশ্চিন্তা হলো! অফিসারের চোখগুলো দেখতে হাসিমোটোর ছোটবেলায় দেখা অনি নামের এক দানবের ছবির মতো। এরকম ছেলেমানুষী ভাবনা মন থেকে সরিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন। এখন তিনি আর সেই সাত বছর বয়সী ছোট্ট হাসিমোটো নন। কল্পিত দানব নয়, যুদ্ধের শুরু থেকে বাস্তব জীবনে অনেক মানুষাকৃতির দানব দেখেছেন তিনি। অতীতের কাল্পনিক দানবে বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই।‘