মুহূর্তের মধ্যে শুরু হওয়া প্রলয় মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল। আর কোনো তাণ্ডব নেই। পৃথিবী এখন আর দুলছে না। তবে সদ্য তৈরি হওয়া ফাটল থেকে হিস হিস আওয়াজ আর ভূমিকম্পের ফলে আহত ব্যক্তিদের গোঙানি শোনা যাচ্ছে এখনও। যারা বেঁচে আছে সবাই হাঁটু গেড়ে বসল। পুরোহিতের নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছে। আতঙ্কিত চোখে সাগরের উপর দিয়ে চোখ বোলালেন পুরোহিত। জোর খাঁটিয়ে নিজেকে দাঁড় করালেন।
‘দৌড়াও সবাই! উঁচু জায়গায় আশ্রয় নাও!’ চিৎকার করে নির্দেশ দিয়েই তিনি নিজেও কম্পিত পায়ে দৌড়াতে শুরু করলেন। যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে সরতে হবে। পূর্বপুরুষদের কাছে এরকম জলোচ্ছ্বাসের গল্প শুনেছেন তিনি। যখন পৃথিবী আর সাগরের দেবতারা প্রভাব বিস্তারের জন্য যুদ্ধ করতে শুরু করে তখন এরকম দূর্যোগ দেখা দেয়। পুরোহিতের চিন্তা হচ্ছে সাগর একটু আগে যে রূপ দেখিয়ে নতুন প্রাসাদকে গ্রাস করে নিয়েছে সামনে আরও ভয়ঙ্কর রূপধারণ করে আঘাত হানতে পারে।
নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটছে সবাই কিন্তু খুব কম লোকই সফল হলো। সুনামি যখন দ্বীপে আঘাত করল তখন জলরাশির উচ্চতা ১০০ ফুট। দ্বীপের পাড়ে থাকা পাথরগুলোকে দ্বীপের এক মাইল ভেতরে নিয়ে গেল সুনামি। ফেরার সময় সব ধুয়ে মুছে নিয়ে গেল। যেন সব চেটেপুটে পরিষ্কার করে নিয়ে গেলেন সমুদ্রের দেবতা!
সে-রাতে সাগরপাড় থেকে যত দূরে সম্ভব সরে গিয়ে জীবিত ব্যক্তিদের নিয়ে ক্যাম্পফায়ার করে গোল হয়ে বসলেন পুরোহিত। সাগরকে আর তারা ভাল চোখে দেখতে পারছে না। সাগর আর বন্ধু নয়।
‘দিন শেষ,’ বললেন পুরোহিত। আমাদের রাজা দেবতাদেরকে রাগিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া এই ঘটনার আর কোনো ব্যাখ্যা নেই। প্রকৃতির উপর দিয়ে হাত ঘোরানোর জন্য এই শাস্তি হলো আমাদের। এখন আমরা আমাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব এবং আগের মতো সুখ-শান্তি ফিরে চাইব।
উপস্থিত সবাই মাথা নাড়ল। ওদের রাজা নিজেকে দেবতাদের কাতারে ফেলেছিলেন। আর তিনি তার বেয়াদবির শাস্তিও পেয়েছেন। অহংকার করলে পাপ হয়। সেই পাপের শাস্তি পেয়েছেন তিনি। তাঁর নির্মিত ইমারতসহ সাগরের বুকে বিলীন হয়ে গেছেন। রাজা লক-এর কোনো নাম-নিশানাও নেই এখন। যেন তিনি কখনও এখানে ছিলেনই না!
পরের দিনগুলোতে জীবিত ব্যক্তিরা দেবতাদের এরকম নৃশংস বিচার নিয়ে ফিসফিস করে আলাপ করল। তিন রাত পর পুরোহিত এক সভা ডাকলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হলো রাজা ও তাঁর রাজ্যের নাম আর কখনও যেন উচ্চারিত না হয়। তাঁর সেই মন্দির, ইমারত কোনো কিছু নিয়েই যেন আর কথা না হয়, সব ভুলে যেতে হবে। তার যাবতীয় কর্ম ভুলে, তার অস্তিত্বকে মুছে দিলে হয়তো দেবতাদের কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়া যাবে।
যেখানে ইমারত নির্মাণ করা হয়েছিল সেই স্থানকে অভিশপ্ত ঘোষণা করা হলো। দিন যেতে যেতে মানুষ একসময় ভুলে গেল ঠিক কী কারণে সাগরের ওই অংশকে অভিশপ্ত বলা হয়েছিল। দ্বীপের স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে শুরু হলো অন্ধকার যুগ। সেই ঘটনার পর দ্বীপে নানান অসুখ-বিসুখের প্রকোপ দেখা দিতে শুরু করেছিল। এত বছর ধরে দ্বীপের যে সুনাম তৈরি হয়েছিল সেটা পরিণত হলো দুর্নামে।
মাঝে মাঝে রাজার নাম অভিশাপের মন্ত্রে শোনা যায়। সেই লাখ লাখ বছরঅলা ভবিষ্যত্বাণীর কোনো মূল্যই নেই এখন। কয়েক প্রজন্মের মধ্যে রাজা লক-এর স্থান হলো নিষিদ্ধ গল্পে। যে গল্পগুলো শুধু ফিসফিস করেই শোনানো হয়। আরও কয়েক প্রজন্ম পর রাজা লক-এর ঘটনা স্রেফ লোককাহিনিতে পরিণত হলো। তরুণরা আর তার কাহিনিকে পাত্তা দেয় না। অতীতের ভয়ঙ্কর কাহিনি শোনার সময় নেই তাদের।
.
০২.
সলোমন সাগর, ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ, ১৯৪৩ সাল
প্রবল বাতাস সাগরের পানিতে সাদা ফেনার সৃষ্টি করেছে। সেই ফেনা কেটে এগোচ্ছে জাপানিজ ডেস্ট্রয়ার কোনামি। বুগেইনভিল আইল্যাণ্ডের দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে এগোচ্ছে জাহাজ। রাতের আঁধার চারিদিকে অথচ জাহাজে কোনো আলো জ্বালানো হয়নি। অন্ধকারের ভেতর সাগরের বড় বড় ঢেউ মোকাবেলা করে জাহাজ এগোচ্ছে। চল্লিশ-পঞ্চাশ ফুট উঁচু ঢেউ এসে জাহাজের সামনের অংশে আঘাত করতেই আর্তনাদ করে উঠছে ইঞ্জিন।
জাহাজের অবস্থা ভাল নয়। গোয়াডালক্যানেল থেকে সর্বশেষ সৈন্যদেরকে সরিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক কোর্স থেকে অনেকখানি সরে গিয়ে চলছে কোনামি।
এই ইয়াগোমো-ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের কার্যকরী ওয়াটারলাইন (জাহাজের যেটুকু অংশ পানিতে ডুবে থাকে) ও মসৃণ ইঞ্জিনিয়ারিঙের বদৌলতে ঘণ্টায় ৩৫ নট গতিতে এগোনোর ক্ষমতা রাখে। কিন্তু আজ তিন ভাগের এক ভাগ গতিতে এগোচ্ছে। খারাপ আবহাওয়ার কারণে কোনামি স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারছে না। কচ্ছপের মতো ধীরগতিতে এগোতে হচ্ছে।
হঠাৎ করে গোয়াডালক্যানেল থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ এসেছে। ওখানে অনেক পরিশ্রম ও সীমিত খাবার পাওয়ায় রোগা-পাতলা হয়ে গেছে সৈন্যরা। তার উপর এখন এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় তারা একদম কাহিল হয়ে পড়েছে। জাহাজের এক নাবিক সৈন্যদের কাছে পানযোগ্য পানি নিয়ে গেল। এই খারাপ পরিস্থিতিতেও যতদূর সম্ভব সৈন্যদেরকে আরাম দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সৈন্যদের পোশাকের অবস্থা শোচনীয়! একদম ন্যাকড়ার মতো হয়ে গেছে। খাবার না পেয়ে শরীরের অবস্থা খুব খারাপ।