বলল, আমি শুনছি।’
‘তোমার কথামতো সলোমন আইল্যান্ড নিয়ে ইন্টারনেটে খোঁজ শুরু করি। কিন্তু ইন্টারনেটে তেমন কোনো তথ্য নেই বললেই চলে।
‘তারপরও তুমি থেমে যাওনি?’
অবশ্যই না। ইন্টারনেট ঘেঁটে ক্লান্ত হয়ে ভাবলাম এমন ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে যারা গোয়াডালক্যানেল-এর ইতিহাস সম্পর্কে জানে। খোঁজ নিয়ে দেখি দ্বীপের অনেকেই বিভিন্ন সময় অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে গিয়ে বাস করেছে। কারণ, দ্বীপের নিকটবর্তী এই দুটো দেশই বেশ উন্নত।
‘ঠিক…’ স্যাম বেশ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। এসব ভণিতা শেষ করে সেলমা কখন আসল কথা বলবে।
‘সিডনিতে আমার কিছু বন্ধু আছে। তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম ওই দ্বীপের ইতিহাস সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল জ্ঞান রাখেন এক ভার্সিটির নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর। নাম: ড, সিলভিস্টার রোজ। প্রফেসরকে ফোন করলাম আমি। কথা বললাম অনেকক্ষণ। অমায়িক ব্যক্তি।
‘খুব ভাল করেছ।’ বলল স্যাম। মনে মনে আশা করল, সেলমা যেন খুব দ্রুত মূল প্রসঙ্গে কথা বলে।
‘প্রফেসর সাহেব বিগত কয়েক বছর যাবত দ্বীপটাকে নিয়ে গবেষণা করছেন। দ্বীপের সংস্কৃতি, বাসিন্দাদের স্বভাব, লোককাহিনি সংগ্রহ করে আসছেন। তাকে ডুবে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ আর অভিশপ্ত সৈকত নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি কোনো জবাব দেননি। তবে বলেছিলেন, লগ-বুক দেখে জানাবেন। তো গতকাল প্রফেসর আমাকে নিজেই ফোন করে জানালেন, যা খুঁজছিলেন সেটা পেয়েছেন এবং সেগুলো পাঠিয়েও দিয়েছেন আমার কাছে।
তুমি পেয়েছ সেগুলো?
হ্যাঁ। তোমাকে পড়ে শোনাতে চাই।’
স্যাম চোখ বন্ধ করল। তাহলে তো খুব ভাল হয়।
ঠিক আছে, পড়ছি। “… এখানকার একটা গল্প নিয়ে আলোচনা করা একদম নিষিদ্ধ। কিন্তু নিষিদ্ধ হলে যেটা হয় গোপনে গোপনে সবাই সেই গল্প নিয়ে আলোচনা করত। আলোচনা হতো বলেই গল্পটা নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এখনও টিকে আছে। নইলে অনেক আগেই কালের গভীরে হারিয়ে যেত। গল্পটা আমি শুনেছিলাম গোয়াডালক্যানেলের এক কবিরাজের মুখে। স্থানীয় এক সর্দার আমাকে তাঁর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে তিনি মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত বছরে একবার হলেও আমি আর সেই কবিরাজ দেখা করতাম। গতবছর যখন দেখা হয়েছিল তখন একরাতে গল্পটা বলেছিলেন তিনি।”
সেলমা একটু থেমে গলা পরিষ্কার করে নিল। অনেক বছর আগের কথা। শ্বেতাঙ্গরা এই দ্বীপে আসার আগে… তখন দ্বীপ জুড়ে সব স্থানীয় লোকজন বসবাস করত। একজন রাজা ছিল তাদের। তবে সে কোনো সাধারণ রাজা ছিল না। জাদু জানত। সাগর, আকাশ ও ধরণীর দেবতাদের নির্দেশ দিতে পারতো সে। দ্বীপের বাসিন্দাদেরকে নিয়ে এক শক্তিশালী জাতি গড়েছিল। যুদ্ধের ময়দানে তার শক্তির জন্য সবাই পেত, তেমনি প্রজাদের প্রতি উদার মানসিকতার জন্য ভালওবাসত সবাই। রাজার নাম ছিল লক। তাঁর জীবদ্দশায় এই নাম খুব বিখ্যাত ছিল।”
ইন্টারেস্টিং।
‘গল্প তো কেবল শুরু। “একপর্যায়ে রাজা ঘোষণা দিয়েছিল আলিশান ইমারত তৈরি করা হবে। যেরমকটা এরআগে কেউ কখনও দেখেনি। শ্রমিকদের অনেক বছর পরিশ্রমের মাধ্যমে পাথরের সাহায্যে সাগরে একটা ইমারত নির্মিত হলো। রাজা তো আছে। এবার একটা রাণী দরকার। দ্বীপের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করল রাজা। পাত্রীও সম্ভ্রান্ত ঘরের। দ্বীপের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সর্দারের মেয়ে। কথিত আছে, রাণী খুব সুন্দরী ছিল। ফলে রাজা নিয়ম করে দিয়েছিল কেউ যেন রাণীর দিকে সরাসরি চোখ তুলে না তাকায়। বলা হয়ে থাকে সেখান থেকেই এই দ্বীপের মেয়েদের দিকে সরাসরি চোখ তুলে না তাকানোর রীতি চালু হয়েছে।”
‘আর ভেবেছিলাম লজ্জার কারণে সরাসরি তাকানো হয় না।
‘উঁহু, তা নয়। “ইমারত নির্মাণ শেষ হওয়ার পর একদিন সকালে বেশ ঘটা করে দ্বীপের সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সপ্তাহব্যপী আনন্দ উৎসব করার উদ্দেশে। এরআগে কয়েক মাস ব্যপী বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও বনিকদের কাছ থেকে উপটৌকন সংগ্রহ করেছিল রাজা। যাবতীয় সোনা-দানা, মূল্যবান রতু সব নতুন ইমারতের কোষাগারে রাখা হয়েছিল। রাজা এসব রত্ন প্রদর্শন করছিল সকালের সূর্য উদয়ের সময়। পাশে ছিল তাঁর প্রধান পুরোহিত ও সুন্দরী স্ত্রী। কথিত আছে, দেবতারা রাজার এরকম অহংকার প্রদর্শনে ক্ষিপ্ত হয়ে ভূমিকম্প ঘটান। ওরকম মারাত্মক ভূমিকম্প এরআগে দ্বীপের বাসিন্দারা কখনও দেখেনি। ভূমিকম্পে দ্বীপের অনেক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি রাজার আলিশান ইমারতও সাগরে তলিয়ে যায়। যারা ইমারত দেখতে এসেছিল তাদের অধিকাংশ নিখোঁজ হওয়ার পর অল্প কয়েকজন প্রাণে বাঁচতে পেরেছিল তখন। এই ভূমিকম্পের পর তারা অনুধাবন করল, রাজার অত্যাধিক বাড়াবাড়ির কারণেই এরকম দূর্যোগ দেখা দিয়েছে। প্রাপ্য শাস্তি পেয়েছে রাজা। তাই এরকম রাজার নাম দ্বীপবাসীরা আর কখনও উচ্চারণ করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁর নির্মিত ইমারত, মন্দির কোনোকিছুই নিয়ে কোনো কথা বলা চলবে না। সেইসাথে সাগরের ওই অংশকে অভিশপ্ত বলে ঘোষণা করা হয়।” লেখাটা এখানেই শেষ।
‘তাহলে সলোমন আইল্যান্ডের এরকম রীতিনীতি সরাসরি ওই ভূমিকম্পের ফল?
‘সেরকমটাই তো দেখছি। কিন্তু আমি আটকে গেছি একটা বিষয়ে। সেটা হলো, ধন-রতুগুলো দেবতাদের ক্ষীপ্ত হওয়ার একটা মূল কারণ। যেটার পরিষ্কার মানে দাঁড়াচ্ছে, ওই সম্পদগুলোকেও আর ছুঁয়ে দেখার সাহস করেনি।