পুরোহিত একটু থামলেন। সামনে যেন এক অলৌকিক দৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন তিনি। প্রাসাদ দেখা যাচ্ছে! সমুদ্রের ঠিক যেখানে আগে শুধু পানি দেখা যেত সেখানে এখন মানুষ নির্মিত ইমারত গড়ে উঠেছে। হাত বাড়িয়ে পেছনের লোকদের এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখালেন। প্রার্থনার সুরে রাজার নাম জপলেন পুরোহিত। ইমারত দেখে মনে হচ্ছে, রাজা যেন সরাসরি স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে এসেছেন। একজন সাধারণ মানুষ থেকে নিজের জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন এই রাজা।
রাজা লক-এর এই অর্জন তার নিজের অন্যান্য অর্জনকে নিষ্প্রভ করে দিয়েছে। অনুষ্ঠানের পর এই প্রাসাদকে রাজকীয় বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
দ্বীপের পুরোহিত এই ইমারতকে রাজা লক-এর ঐশ্বরিক শক্তির নিদর্শন হিসেবে ধরে নিলেন। রাজার হাজার হাজার শ্রমিক প্রায় এক যুগ সময় ব্যয় করে এটা নির্মাণ করেছে। দ্বীপ থেকে পাথর বয়ে নিয়ে গেছে সমুদ্রে। অনেক পরিশ্রম করেছে। এরকম নির্মাণশৈলী এরআগে কেউ কখনও দেখেনি। মহামান্য রাজা তার উপদেষ্টাদের বলেছেন, এই ইমারত নির্মাণের মাধ্যমে এক নতুন যুগের শুভ সূচনা ঘটল।
সবাই রাজার এই বক্তব্যের সাধে সম্পূর্ণ একমত। রাজা লক এই দ্বীপকে সাধারণ থেকে এক সম্পদশালী রাজ্যে পরিণত করেছেন। প্রজাদের মাঝে অঢেল সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। মূল্যবান রত্ন আর সোনার খনি খুঁড়ে দ্বীপের চেহারা বদলে দিয়েছেন। অন্যান্য দ্বীপ ও অঞ্চলের সাথে ব্যবসায়ের নতুন দিগন্ত উন্মাচিত হয়েছে তার হাত ধরে।
কয়েক বছরের মাঝে দ্বীপের বাসিন্দারা লক্ষ্য করল তারা বেশ ধনী হয়ে উঠেছে। সূদূর জাপান থেকেও ব্যবসায়ীরা এসে সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান রত্নের বিনিময়ে বিভিন্ন পণ্য দিয়ে যায়। তবে সোনার চাহিদা ছিল একদম তুঙ্গে। দ্বীপের বাসিন্দারা পাহাড়ে মূল্যবান ধাতুর খনি খুঁড়তে শুরু করল। নিশ্চিন্তে কাজ করত সবাই, কারণ ওরা জানে রাজা লক ওদের উপর দৃষ্টি রেখেছেন।
পুরোহিতের অনুসারীরা তার পিছু পিছু এসে পাশের জায়গাগুলো ভরাট করে দাঁড়াল। সবাই অবিশ্বাস নিয়ে পাহাড় থেকে ইমারত দেখছে। উপজাতির এক সর্দার পুরোহিতের কাছে গিয়ে ইমারতের পাশের একটা জায়গা নির্দেশ করে দেখাল। ওখানে পাথর দিয়ে নির্মিত এক মন্দির থেকে কয়েকজন ব্যক্তিকে বেরোতে দেখা যাচ্ছে।
‘উনি কি রাজা লক? ওখানকার সবচেয়ে লম্বা লোকটার দিকে নির্দেশ করে জানতে চাইল সর্দার।
‘হ্যাঁ, উনিই।’ পুরোহিত জবাব দিলেন। রাজার পরনে থাকা বিশেষ টিউনিকটা (জোব্বা ধরনের জামা) বিভিন্ন মূল্যবান রত্ন ও সোনায় মোড়ানো হওয়ায় সূর্যের আলো লেগে চকমক চকমক করছে।
‘মন্দিরটা চমৎকার,’ বলল সর্দার। ভবিষ্যত্বাণী অনুযায়ী আমাদের পথচলার ১০ লাখ বছরের শুরুটা হয়েছিল এই মন্দিরের মাধ্যমে।
এটা সর্বস্বীকৃত যে, রাজা লকের হাত ধরে দ্বীপ স্বর্ণযুগে প্রবেশ করেছে। একটা সময় আসবে যখন এই রাজ্য হবে পুরো অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র ও শক্তির উৎস। সবকিছুকে হারিয়ে দাপট দেখাবে গোয়াডালক্যানেল। ভবিষ্যত্বাণী অনুযায়ী সেই দাপট ২৫ প্রজন্ম ধরে চলবে। ভবিষ্যৎবাণীতে একজন বিশেষ ব্যক্তির’র কথা বলা আছে। যার অনেক জাদুময় ক্ষমতা থাকবে। এখানকার সবাই বিশ্বাস করে রাজা লক হলেন সেই বিশেষ ব্যক্তি। এই দ্বীপ থেকে এত সোনা ভোলা হচ্ছে, এটা শুধুমাত্র তার জন্যই সম্ভব হয়েছে। পৃথিবী যেন ভেতরে থাকা সব সম্পদ তার হাতে ঢেলে দিয়ে হালকা হতে চাইছে, বশ্যতা স্বীকার করেছে নতুন মনিবের কাছে।
মাথা নাড়ল সর্দার। রাজা লক কোনো সাধারণ ব্যক্তি নন, এটা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। সর্দারের মনে একবার সংশয় জাগল, ইমারতের পেছনে থাকা সাগর যদি পুরোটা ডুবিয়ে দেয়? ভাসিয়ে নিয়ে যায়? কিন্তু তখনও সে জানে না নিজের দ্বীপে ফেরার সময় অলৌকিক খবর নিয়ে ফিরবে সে।
হঠাৎ কিচির-মিচির আওয়াজ তুলে এক ঝাঁক পাখি আকাশে ডানা মেলল। পাখিদের ডাকাডাকিতে খান খান হয়ে গেল ভোরের নীরবতা। পুরোহিত হতভম্ব হয়ে চারিদিকে চোখ বুলালেন, কী হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছেন না। মাটি কাঁপতে শুরু করল এবার। কম্পনের সাথে যোগ হলো চাপা গর্জন। পুরোহিতের গলায় শ্বাস আটকে যাওয়ার দশা। পায়ের তলা মাটি এখন এমন আচরণ করছে যেন এটা একটা জাহাজের ডেক, আর জাহাজটা এখন ঝড়ের কবলে পড়ে নাকানি-চুবানি খাচ্ছে। নিজেকে স্থির রাখার জন্য পাশে থাকা এক গাছের দিকে হাত বাড়ালেন পুরোহিত।
পায়ের তলার মাটি চিড়ে দু’ফাঁক হয়ে যেতেই এক লোক চিৎকার করে উঠল। পরমুহূর্তে পড়ে গেল ফাটলের ভেতর। আরও ফাটল তৈরি হতেই তার আশেপাশের লোকজন সব ছিটকে সরে গেল এদিক-ওদিক। পুরো দুনিয়া যেন দুলছে। হাঁটু গেড়ে বসলেন পুরোহিত, প্রার্থনা করতে গিয়েও সদ্য নির্মিত ইমারতের দিকে চোখ পড়তেই সেটা তার ঠোঁটের মাঝে আটকে গেল।
একটু আগে যেখানে মন্দির আর জৌলুসপূর্ণ প্রাসাদ ছিল সেটা এখন নেই! সাগরের পানি উঠে এসে প্রাসাদকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে গেছে। প্রকৃতির উপর দিয়ে যে রাজা পণ্ডিতি ফলিয়ে এত বছর সময় ব্যয় করে জিনিসটা নির্মাণ করেছিল এখন ইমারত ও এর নির্মাতা কারওই কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। দশ বছর ধরে বানানো প্রাসাদকে এক মুহূর্তের ভূমিকম্প স্রেফ গায়েব করে দিয়েছে। গিলে নিয়েছে পুরো প্রাসাদ।