বিজলি চমকাল আকাশে। স্বর্গ থেকে যেন বৃষ্টি নামতে শুরু করল। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগোতে এগোতে হাসি ফুটল আলভোর ঠোঁটে। বৃষ্টির কারণে কুকুরগুলো হয়তো ওকে ঠিকঠাকভাবে অনুসরণ করতে পারবে না।
আকাশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল বিজলির রেখা। ঝলসে উঠল আকাশ। বাঁ পাশে ভারি পাতায় ঢাকা একটা পথ দেখতে পেল ও। মুহূর্তের মধ্যে আলভো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। জঙ্গলের মাটি বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। পানির পাশ ধরে এগোচ্ছে আলডো। কিন্তু ওর কানে এলো কুকুরগুলো ঠিক ওর পিছু পিছুই আসছে। আলডো আর কুকুরগুলোর মাঝে দূরত্ব কম থাকায় এরকমটা হয়েছে।
কুকুরগুলোকে পেছন থেকে খসিয়ে দেয়ার আশা আর করা যাচ্ছে না। দ্রুত এগোতে হবে- ভাবল আলডো। অন্ধের মতো ছুটছে ও, রক্ত ঝরছে পা থেকে।
হঠাৎ পা হড়কে পড়ে গেল আলছো। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ওকে নিচে টেনে নিয়ে গেল। ঢাল বেয়ে নিচে গড়াতে গড়াতে গতি কমাতে চাইল আলডো। আচমকা একটা গাছের গুঁড়ির সাথে আটকে ওর গতি থেমে গেল।
নিজেকে সামলে নেয়ার পর আলো আবিষ্কার করল ওর মাথা আর আঙুলে রক্ত লেগে রয়েছে। ডুবন্ত ব্যক্তির মতো বাতাস ফুসফুসে ভরার জন্য হাসফাস করছে ও। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে জ্ঞান হারানো ঠেকাতে চেষ্টা করছে আলডো।
পাজর আর বাঁ হাতে তীব্র ব্যথা। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখল ওর হাড় ভেঙ্গে গেছে। কপাল ভাল, পায়ের হাড় ভাঙ্গেনি। ব্যথার কষ্ট আর বৈরি আবহাওয়া ভুলে চারিদিকে চোখ বুলাল ও। প্রায় অন্ধকার সব। উপর থেকে গড়িয়ে পড়ার পর ওর দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে গেছে। ঝাপসা দৃষ্টিতে একটা পথ ওর চোখে পড়ল। সেদিকে এগোল ও।
নিজের হৃদপিণ্ডের আওয়াজ আলভোর কানে ড্রামের মতো বাজছে। সহ্য ক্ষমতার সর্বোচ্চ সীমায় চলে এসেছে ও। প্রতিবার শ্বাস নেয়ার সময় তীব্র ব্যথা হচ্ছে ভাঙ্গা পাজরে। এক কিনারে সরে যেতেই পেছন থেকে আসা আওয়াজ কমতে শুরু করল। অবশেষে ওর মনে হলো, হয়তো এ-যাত্রায় বেঁচে যেতে পারবে।
হঠাৎ গাছের গুঁড়ির সাথে হোঁচট খেয়ে ভূপাতিত হলো আলভোর আছড়ে পড়তেই আর্তনাদ করে উঠল বেচারা। পানি গড়িয়ে পড়ল ওর চোখ দিয়ে। ওর সামনে থেকে পুরো দুনিয়া মুছে গেল।
জ্ঞান হারিয়েছে।
কয়েক মিনিট পর যখন জ্ঞান ফিরল, আলভো দেখল কুকুরের নাক ওর মুখের সামনে গন্ধ শুঁকছে। একজনের কথা শুনতে পেল ও। কথার শেষ অংশটুকু শুনে আলডো নিশ্চিত হলো ওর জীবনের এখানেই সমাপ্তি। আর কখনও কোনো কথা শোনা হবে না ওর।
‘তুই জানিস না, এই দ্বীপ থেকে পালানো তোর কম্ম নয়?’
মুখের সাথে মগজের সমন্বয় ঘটিয়ে কিছু একটা বলার আগেই আলডোর কপাল বরাবর একটা বুট ধেয়ে এলো। ও কোনো বাধা, আর্জি কিংবা অভিশাপ কিছুই দিতে পারল না। লাথি খেয়ে চোখের সামনে তারা জ্বলতে দেখল আলডো। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে ওর। বাধা দিতে চাইল, কিন্তু ওর হাত-পাগুলো যেন সীসার মতো ভারি হয়ে গেছে।
আলডো ভাবল, কোথাও একটা গড়বড় হয়েছে। ভুল বোঝাবুঝি কিংবা ভুল হয়েছে কোথাও। ভাবতে ভাবতে আবার ধেয়ে এলো বুট। এবার আগের চেয়ে জোরে আঘাত করল সেটা। লাখির জোর বেশি হওয়ায় মড়াৎ করে আলভোর ঘাড় ভেঙ্গে গেল। বেরিয়ে গেল প্রাণবায়ু। মুখের উপর বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আছড়ে পড়ছে। কিন্তু আলডো আর এখন এসব কিছুই অনুভব করতে পারছে না। অন্য দুনিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে সে।
.
০১.
গোয়াডালক্যানেল, সলোমন আইল্যাণ্ড, ১১৭০ এ.ডি.
শান্ত সাগরের বুক থেকে সবেমাত্র সূর্য উঠতে শুরু করেছে। বনের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে দ্বীপের বাসিন্দারা। ফিসফিস করছে সবাই। সমুদ্রের ঠিক উপরেই এক নতুন শহর বানানো হয়েছে। সেটাই দেখতে যাচ্ছে এরা।
সবার সামনে রয়েছেন প্রধান পুরোহিত। এখন বেশ গরম পড়েছে কিন্তু তিনি সেটাকে তোয়াক্কা না করে রংচঙে গাউন পরে এসেছেন। ইতিমধ্যে ঘাম দেখা দিয়েছে তার চেহারায়। অনেকে গোয়াডালক্যানেলের পশ্চিম অংশে নির্মিত নতুন প্রাসাদে তীর্থযাত্রা সেরে ফেললেও প্রধান পুরোহিত সবেমাত্র নিজের দলবল নিয়ে এগোচ্ছেন। পেছনে তাকালেন পুরোহিত। তার চেহারায় সন্তুষ্টি ফুটে উঠল। এই যাত্রার জন্য তিনি রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ লোকদেরকে সাথে নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে কিছুদিন হলো পার্শ্ববর্তী দ্বীপে এসে উঠেছিল। আজকের এই অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়ে রাখা হয়েছে পাক্কা এক সপ্তাহ আগে। এক সপ্তাহ, সবার প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময়।
জঙ্গলের ডালপালা ভেদ করে ভোরের রূপোলি আলো উঁকি দিচ্ছে। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে এগোচ্ছে সবাই। এই দ্বীপটা বেশ বৈচিত্রময়। গোয়াডালক্যানেলের স্থানীয় উপজাতিরা সাগরের পাড় থেকে ৩০০ ফুটের ভেতরে বাস করে। দ্বীপের গভীরে যেতে চায় না ওরা। অনেক দৈত্য দানবের কাহিনি প্রচলিত আছে দ্বীপকে কেন্দ্র করে। সেগুলোর কিছু বাস্তব আর কিছু কল্পিত। দ্বীপের বিভিন্ন ভূগর্ভস্থ গুহাতে আছে দৈতাকার জন্তু, মানুষের চেয়ে দ্বিগুণ আকৃতির ভয়ঙ্কর দানব। অসতর্ক, বেখেয়ালি মানুষের রক্ত পান করে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য ওঁত পেতে রয়েছে ওগুলো। কে দ্বীপের ভেতরে গিয়ে নিজের প্রাণ খোয়াতে চাইবে? আর জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু যখন সাগর থেকেই পাওয়া যাচ্ছে তখন ঝুঁকি নিয়ে দ্বীপের ভেতরে যাওয়ার তো কোনো দরকার নেই।