সেই সাথে শেষ হয়ে গেল গত একমাসে ওদের এতো পরিশ্রম। সাথে হাত ছাড়া হয়ে গেল জীবনের শ্রেষ্ঠতম সুযোগ। শুধু ভিয়েনেভের দখল নেয়া ট্রাঙ্কটাই সম্বল এখন।
দ্য চ্যাম্পিয়ন ধপ করে ডেকের ওপর বসে পড়ল, “মিসরীয়রা আমাকে আগেই বলেছিল।” বলল ও।
“আগেই বলেছিল?” জিজ্ঞেস করল নাৰিক।
মৃতদের শহর থেকে কিছু নিতে নিষেধ করেছিল। তাহলে নাকি অভিশাপ লাগবে। বার বার একটা অভিশাপের কথা বলছিল….কুসংস্কার ভেবে তখন হেসেই উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন,…”
দ্য শ্যাম্পেন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু আবার পড়ে গেল। নাবিকটা এসে ওকে ধরে নিচে নিয়ে গেল। তারপর সেখানে বসে বসে ইংরেজদের আগমনের অপেক্ষা করতে লাগল।
আক্রমণটা এলো ভোরের দিকে। ব্রিটিশরা আবার জড়ো হয়ে বাকি ফরাসি জাহাজগুলো ঘায়েল করতে বেরিয়েছে। কিন্তু মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি বা গোলার আঘাতে কাঠের মড়মড় শব্দের পরিবর্তে দ্য শ্যাম্পেন বাতাসের শব্দ শুনতে পেল। তার মানে শুইলাম টেল চলতে আরম্ভ করেছে।
দ্য শ্যাম্পেন ওপরে উঠে এসে দেখে জাহাজ পূর্ণ গতিতে উত্তর-পূর্ব দিকে ছুটছে। ব্রিটিশরাও ধাওয়া করছে কিন্তু ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। দূর থেকেই আলোর ঝলকানি দেখে বোঝা গেল গোলা ছুড়ছে। কিন্তু কোনোটা ধারে কাছেও এলো না। কিছুক্ষণ পর ওদের জাহাজগুলোর পালও হারিয়ে গেল দিগন্তের ওপারে।
দ্য’ শ্যাম্পেন ভিয়েনেভের সাহসের ব্যাপারে সন্দিহান, তবে লোকটা যে ধূর্ত সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আজও বেঁচে থাকার জন্যে ভিয়েনেভের কাছে ঋণী।
সকাল পড়ে আসতেই শুইলাম টেল আর ভিয়েনরে অধীনে থাকা বাকি তিনটা জাহাজও নেলসন আর ওর সাঙ্গপাঙ্গদের বহুদূর ফেলে এগিয়ে গেল। সেখান থেকে তারা মাল্টায় পৌঁছায়। দ্য শ্যাম্পেন তার বাকিটা জীবন সেখানেই অতিবাহিত করে। গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত ছিল বেশির ভাগ সময়। ভিয়েনেভ আর নেপোলিয়নের সাথে চিঠি চালাচালিও হয়েছে কয়েকবার। তবে কী রহস্য সে মিসর থেকে উদ্ধার করে এনেছিল সেটার হদিস বের করতে না পারার আক্ষেপ তার আমৃত্যু ছিল।
.
০২.
এম. ভি. তোরিনো, মাল্টার পশ্চিমে সত্তর মাইল দূরে
বর্তমান সময়
এম. ভি. তেরিনো একটা তিনশ ফুটি মালবাহী জাহাজ। পুরো কাঠামোটাই স্টিলের তৈরি। ১৯৭৩ সালে প্রথম পানিতে ভাসানো হয় জাহাজটা। কালের থাবায় আগের জৌলুস আর নেই জাহাজটার। স্পিডও তুলতে পারে না বেশি, তাই এখন আর বেশি দূরত্বে যায় না। ভূমধ্যসাগরের হোট ছোট কিছু দ্বীপ বা কালেভদ্রে লিবিয়া, সিসিলি, মাল্টা আর গ্রিসেই এটার যাত্রা এখন সীমাবদ্ধ।
ভোর হতে আর এক ঘণ্টা বাকি। মাল্টা থেকে সত্তর মাইল দূরে এখন জাহাজটা। যাচ্ছে পশ্চিমে ছোট্ট একটা ইতালি নিয়ন্ত্রিত দ্বীপ ল্যাম্পেডুসাতে।
এই শেষ রাতেও জাহাজের ওপর বেশ কয়েকজন মানুষের ভিড়। প্রত্যেকেই খুব নার্ভাস। অবশ্য সেটা হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। গত এক ঘণ্টা ধরে একটা নামহীন জাহাজ ছায়ার মতো ওদের জাহাজকে অনুসরণ করছে। জাহাজটার বাতি নিভানো। ধীরে ধীরে দূরত্ব কমছে।
“ওটা কী আরো কাছে চলে এসেছে নাকি?”
চিৎকার করে জাহাজের মাস্টার প্রশ্নটা করল, নাম কনস্ট্যানটিন ব্রাকো। গাট্টাগোট্টা গড়ন, পাকানো পেশি, মাথায় লাল-সাদা চুলে ভরা। তিনদিন দাড়ি না কামানোয় মুখটা দেখাচ্ছে সিরিষ কাগজের মতো।
এই মুহূর্তে জাহাজের হুইল ধরে আছে সে। জবাব না পেয়ে আবার হাক ছাড়লো, “কি হলো?”
“জাহাজটা এখনো দেখা যাচ্ছে। আমাদের দিকেই ঘুরছে। গতিও বাড়ছে বোঝা যাচ্ছে।” ফাস্ট মেট জবাব দিল।
“সব লাইট নিভিয়ে দাও।” ব্রাকো নির্দেশ দিল।
একজন ক্রু মাস্টার সুইচ টিপে দিতেই পুরো তোরিনো আঁধারে ডুবে গেল। সেই সুযোগে ব্রাকো আবারো জাহাজের মুখ আরেকদিকে ঘুরিয়ে দিল।
“ওদের কাছে রাডার বা নাইট ভিশন গগলস থাকলে কিন্তু এসব করে কোনো লাভ হবে না।” ফাস্ট মেট বলল আবার।
“কিছুটা সময় তো অন্তত পাওয়া যাবে।” ব্রাকো জবাব দিল।
“এরা বোধহয় কাস্টমসের লোক বা ইতালিয়ান কোস্ট গার্ডং” আরেকজন ক্রু জিজ্ঞেস করল।
ব্রাকো মাথা নাড়লো, “তা হলে তো ভালোই হয়। বেঁচে যাবে।”
ফার্স্ট মেট ইঙ্গিতটা ধরতে পারলো, “মাফিয়া?”
ব্রাকো মাথা ঝাঁকালো, “আমাদের আগেই বখরা দিয়ে আসা উচিত ছিল। ওদের এলাকায় চোরাচালান করছি। ভাগ তো চাইবেই।”
ব্রাকো ভেবেছিল অন্ধকারে হয়তো ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে, কিন্তু একটু পরেই বুঝলো যে চালে ভুল হয়ে গেছে।
“অস্ত্রপাতি বের করো। লড়াই করা ছাড়া উপায় নেই।” আদেশ করল সে।
“কিন্তু কনস্ট্যানটাইন, গোলাগুলি হলে কিন্তু গোলাগুলির সময় কন্টেইনারগুলোতে গুলি লাগলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
তেরিনোর ডেক ভরা অনেক ভিন্ন মালবাহী কন্টেইনার। কিন্তু এগুলোর বেশিরভাগের ভেতর-ই তরল পোপেনের একেকটা ট্যাঙ্ক লুকানো। একেকটা ট্যাংক প্রায় একেকটা বাসের সমান বড়। আরো কিছু চোরাচালান সামগ্রীও এর সাথে আছে। মিসরের এক লোক বিশটা ব্যারেল ভরে অজানা এক জিনিস তুলে দিয়েছে। তবে ইউরোপ জুড়ে মাত্রাতিরিক্ত ট্যাক্সের কারণে প্রোপেন চোরাচালানে ব্যাপক লাভ হচ্ছে বর্তমানে।
“শালার চোরাকারবারীদের আজকাল ট্যাক্স দেয়া লাগে,” ব্রাকো নিজেই নিজেকে শোনালো। নিরাপত্তার জন্য টাকা দাও, কারো এলাকা দিয়ে যেতে হলে টাকা দাও, কোথাও জাহাজ ভিড়ালে টাকা দাও। এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সরকারের চেয়ে কোনো অংশে কম না।