“চাবিটা!” ভিয়েনেভ আবার হাত বাড়ালো।
দ্য শ্যাম্পেন আর কি করে। কথা না বাড়িয়ে গলা থেকে চাবিটা খুলে ভিয়েনেভের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “ট্রাংকের সব দায় দায়িত্ব এখন থেকে আপনার অ্যাডমিরাল।”
“সেটাই ভালো। আপনি এখন যেতে পারেন।” ভিয়েনেভ বলল।
দ্য শ্যাম্পেন ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হয়েও আবার ফিরে তাকাল। সাহস করে প্রশ্নটা করেই ফেলল, “আমরা কি যুদ্ধে যোগ দিচ্ছি?”
অ্যাডমিরালের ভ্রূ একটু উঁচু হলো। যেন অবাস্তব কোনো প্রশ্ন করেছে দ্য শ্যাম্পেন।
“এখনো সে রকম কোনো নির্দেশ আসেনি।”
“নির্দেশ?”
“অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েস বা লরিয়েন্টের কোনো পাত্তা নেই অনেকক্ষণ।”
“অ্যাডমিরাল! ইংলিশরা দুপাশ থেকে আক্রমণ করছে। নির্দেশের জন্যে বসে থাকলে তো সব শেষ হয়ে যাবে।” দ্য শ্যাম্পেন বলল।
ভিয়েনেভ চকিত উঠে দাঁড়িয়ে একটা ক্ষ্যাপা ষাড়ের মতো দ্য শ্যাম্পেনকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “তোর এতো বড় সাহস আমাকে কথা শোনাস?”
“না, অ্যাডমিরাল, আমি শুধু–”।
“বাতাস বইছে উল্টো দিকে। ওখানে পৌঁছুতে চাইলে পুরো উপসাগর ঘুরে তারপর যাওয়া লাগবে। এরচেয়ে অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েস পিছু হটে আমাদের কাছাকাছি চলে আসলেই আমরা তার সাথে যোগ দিতে পারতাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তার সে রকম কোনো ইচ্ছা-ই নেই।”
“তাই বলে এখানে চুপচাপ বসে থাকবো?”
ভিয়েনেভ তার ডেস্কের ওপর থেকে একটা ছুরি তুলে নিয়ে বলল, “জায়গায় খুন করে ফেলবো, আর যদি একবার আমার সাথে এভাবে কথা বলিস। পণ্ডিত মশাই! যুদ্ধ বা জাহাজ সম্পর্কে কি জানিস তুই, অ্যাঁ?”
দ্য শ্যাম্পেন বুঝলো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে! “মাফ করবেন অ্যাডমিরাল। আজ দিনটাই আসলে খারাপ।”
“ভাগ এখান থেকে। আর ভাগ্যকে ধন্যবাদ দে যে আমাদের এখনো যুদ্ধে যেতে হচ্ছে না। যদি হয় তাহলে তোকে জাহাজের মাস্তুলে গলায় বেল বেঁধে ঝুলিয়ে রাখবো। যাতে ব্রিটিশরা প্রথমেই তোকে নিশানা করতে পারে।”
দ্য শ্যাম্পেন এক কদম পিছিয়ে মাথাটা হালকা ঝুঁকিয়েই উল্টো দিকে হাঁটা দিল। ওখান থেকে বেরিয়ে ওপরে উঠে এলো ও। জাহাজের সামনের দিকে গিয়ে দূরের ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে লাগল।
এত দূর থেকেও যুদ্ধের ভয়াবহতা ওকে কাঁপিয়ে দিল। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিলো। দূরে দেখা যাচ্ছে দুটো জাহাজ গা ঘেষাঘেষি করে গোলা বর্ষণ করছে। মাস্তুল থেকে মাস্তুল, গলুই থেকে গলুই কিংবা ডেকের ওপর যে যেখান থেকে পারছে উন্মত্তের মতো গুলি করে যাচ্ছে।
“কী সাহস!” দ্য শ্যাম্পেন তন্ময় হয়ে ভাবতে লাগল।
কিন্তু শুধু সাহস থাকলেই হয় না। এই মুহূর্তে ফরাসি বাহিনীর একটা গুলির বিপরীতে প্রায় তিন থেকে চারগুণ বেশি গুলি করছে ব্রিটিশ বাহিনী। আর ভিয়েনেভের অনীহার কারণেই তাদের যুদ্ধরত জাহাজের সংখ্যা এখন বেশি।
যুদ্ধ ক্ষেত্রের ঠিক মাঝে নেলসনের তিনটা জাহাজ মিলে লরিয়েন্টকে আক্রমণ চালাচ্ছে। চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে এখন ওটাকে আর চেনাই যায় না। সুন্দর চকচকে কাঠামো বা বিশাল মাস্তুল বহু আগেই ভেঙে পড়েছে। পুরু কাঠামোর পুরোটাই এখানে সেখানে খাবলা খাবলা উঠে গেছে। কোথাও কোথাও ভেঙে গেছে। যদিও তখনো কয়েকটা কামান অবশিষ্ট আছে, কিন্তু দ্য শ্যাম্পেন, বিশেষজ্ঞ না হয়েও বলতে পারে লরিয়েন্টের সময় শেষ।
হঠাৎ জাহাজটায় আগুন ধরে গেল। দাবানলের মতোই সেটা মেইন ডেকে ছড়িয়ে পড়ল। এখানে সেখানে দেখা গেল ঘন ধোয়ার কুণ্ডলি। দুরন্ত গতিতে আগুনটা সব পালে আর ভাঙা মাস্তুলে ছড়িয়ে পড়ল। তারপর খোলা হ্যাঁচ বেয়ে নিচের খোলেও ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তেই।
হঠাৎ প্রচণ্ড আলোর ঝলকানি। দ্য শ্যাম্পেন সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করেছে কিন্তু তারপরও অন্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্যে। পরমুহূর্তেই শোনা গেল বিকট আওয়াজ। দ্য শ্যাম্পেন জীবনেও এতো জোরালো কোনো শব্দ শোনেনি। শক ওয়েভের প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়ল ও। মাথার চুল পুড়ে গেছে, একটুর জন্যে মুখে লাগেনি।
ও কোনোমতে চিৎ থেকে কাত হলো। বাতাসের জন্যে হাসফাস করছে। কয়েকবার গড়াগড়ি করে কোটের আগুন নেভালো। বহু কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে আবার যুদ্ধের দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেল ওর।
লরিয়েন্ট নেই।
পানির মধ্যে বিশাল একটা এলাকা জুড়ে আগুন জ্বলছে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আশেপাশের ছয়টা জাহাজেও আগুন ধরে গেছে। তিনটা ব্রিটিশ আর তিনটা ফরাসি জাহাজ। যুদ্ধ আপাতত থেমে গেছে। সবাই নিজ নিজ জাহাজের আগুন নেভাতে ব্যস্ত। লরিয়েন্টের পরিণতি কেউ চায় না।
“আগুন নিশ্চয়ই ওটার গোলা রাখার ঘরটায় ঢুকে পড়েছিল।” পাশ থেকে একজন ফরাসি নাবিক বলল দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে।
প্রতিটা জাহাজের খোলেই শত শত ব্যারেল গান পাউডার রাখা। আগুনের একটা স্ফুলিঙ্গও সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে।
ফরাসি লোকটার গাল বেয়ে অশ্রুর ধারা নামল। কিন্তু দ্য চ্যাম্পিয়নের গা গোলাচ্ছে। এসব আবেগ অনুভূতি ওকে আর স্পর্শ করল না।
লরিয়েন্ট যখন আবুকির বন্দরে পৌঁছায় তখন এতে প্রায় হাজারখানেক মানুষ ছিল। দ্য শ্যাম্পেন নিজেও জাহাজটায় চড়েছে। অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েসের সাথে খাবার খেয়েছে। এই অভিযাত্রায় ও যতজনকে চিনতে তাদের সবাই ছিল ঐ জাহাজটাতে। এমনি অফিসারদের বৌ-বাচ্চারাও ছিল ওতে। তাদের মধ্যের কেউ-ই যে আর বেঁচে নেই, কেউ না বলে দিলেও দ্য শ্যাম্পেন সেটা জানে।