দ্য চ্যাম্পিয়নের কাছে মনে হলো দাঁড় বেয়ে এই দোযখের মধ্যে গিয়ে পড়া আর পাগলামি একই কথা। তার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এসেছে, “আচ্ছা ব্রিটিশ জাহাজগুলোকে তো অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েস ভাগিয়ে দেবেন-ই। তখনই শুধু এই ট্রাংকগুলো তাকে পৌঁছে দিলে হবে না?”
এই প্রস্তাবে অফিসার মাথা ঝাঁকালো। তারপর নিজের লোকদের দিকে ফিরে বলল, “দেখলে তো? এজন্যেই জেনারেল এনাকে পণ্ডিত বলে ডাকেন।”
অফিসার বহরের পিছনের একটা জাহাজের দিকে ইঙ্গিত করল। এই জাহাজটা এখনো যুদ্ধ শুরু করেনি। “গুইলাম টেল-এর দিকে যাও। রিয়ার অ্যাডমিরাল ভিয়েনেভ আছেন ওখানে। কি করা উচিত উনিই ভালো বলতে পারবেন।”
নৌকা বাওয়ায় আবার পূর্ণোদ্যম ফিরে পেল সবাই। যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে সাম্পানটা সরে গেল বেশ দ্রুতই। চারপাশে অন্ধকার আর ধোঁয়ায় ভরা থাকলেও নিরাপদেই মাল্লারা সাম্পানটা নৌ-বহরের পিছনের দিকে নিয়ে এলো। চারটা জাহাজ দাঁড়ানো সেখানে। সামনে স্থলস্তুল যুদ্ধ চলছে আর এগুলো এখানে পড়ে আছে। ব্যাপারটা আশ্চর্যজনকই বটে।
সাম্পানটা গুইলাম-টেল’-এর গায়ে ভিড়তেই দড়ির মই নেমে এলো নিচে। দ্রুততার সাথে মানুষ আর মালপত্র সবই তুলে নেয়া হলো জাহাজে।
দ্য শ্যাম্পেন ডেকে পৌঁছে দেখলেন যুদ্ধের অবস্থা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তার কল্পনাতেই কখনো এমন কোনো দৃশ্য ছিল না। ব্রিটিশগুলো সংখ্যায় কমে গেলেও কৌশলগত দিক দিয়ে ওরাই এগিয়ে আছে এখন। ফরাসি জাহাজগুলোর সাথে মুখোমুখি আক্রমণ বন্ধ করে দিয়েছে। পিছনের জাহাজগুলোকেও আর আক্রমণ করছে না, তার বদলে একযোগে সামনের সারির জাহাজগুলোর দিকে গোলা বর্ষণ করছে। ফলে প্রতিটা ফরাসি জাহাজকে এখন দুপাশে দুটো করে ব্রিটিশ জাহাজের সাথে লড়তে হচ্ছে। ফলাফলও অনুমেয়। অজেয় ফরাসি নৌ-বহর আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
“অ্যাডমিরাল ভিয়েনেভ আপনার সাথে দেখা করতে চান।“ একজন স্টাফ অফিসার বলল দ্য শ্যাম্পেনকে। তারপর রাস্তা দেখিয়ে রিয়ার অ্যাডমিরালের কাছে নিয়ে গেল। অ্যাডমিরালের মাথা ভরা সাদা চুল, কেমন চ্যাপটা মুখ, লম্বা কপাল আর নাকটা রোমানদের মতো লম্বা। নিখুঁত একটা ইউনিফর্ম পরনে তার। গাঢ় নীল শার্ট, সেটার এখানে সেখানে সোনালি সুতোর কারুকাজ। বুকে একটা লাল রঙের স্যাশ। দ্য চ্যাম্পিয়নের কাছে মনে হলো যুদ্ধ না, বরং প্যারেড় করতে বেরিয়েছেন অ্যাডমিরাল।
ভিয়েনেভ কিছুক্ষণ ট্রাঙ্কের তালাটা নিয়ে তোণ্ডতি করল। তারপর দ্য শ্যাম্পেনকে বলল, “আপনি সম্ভবত নেপোলিয়নের পণ্ডিতদের একজন।”
পণ্ডিত শব্দটা নেপোলিয়ন ব্যবহার করেন। দ্য শ্যাম্পেন এবং আরো কয়েকজনকে এটা বলে ক্ষেপিয়ে মজা পান তিনি। তারা প্রত্যেকেই বিজ্ঞানী এবং বিদ্বান ব্যক্তি। নেপোলিয়নই তাদের জড়ো করে মিসরে নিয়ে এসেছেন। উদ্দেশ্য এমন কোনো গুপ্তধন খুঁজে বের করা, যা দেহ ও মন দুটোকেই প্রশান্ত করবে।
দ্য শ্যাম্পেন প্রাচীন ভাষার পাঠোদ্ধারের ব্যাপারে একজন উঠতি বিশেষজ্ঞ। আর প্রাচীন ভাষার ব্যাপারে পিরামিড আর স্ফিংস এর দেশের তুলনা আর কোনটা আছে?
আর দ্য শ্যাম্পেন শুধু একজন পণ্ডিত-ই না। নেপোলিয়ন ব্যক্তিগতভাবে তাকে এই অভিযানের জন্যে বাছাই করেছেন। এখানকার সব পৌরাণিক কাহিনীর পিছনের আসল সত্যটা তিনি জানতে চান। বিনিময়ে মোটা পুরস্কারের ওয়াদা করেছিলেন। এতো টাকা দেয়ার কথা ছিল যা দ্য শ্যাম্পেন দশ জনমেও আয় করতে পারতো না। সাথে জমি-জমার প্রতিশ্রুতি তো ছিলই। ধন, দৌলত, সম্মান সবই দ্য শ্যাম্পেন পাবে, তবে তার জন্যে শর্ত একটাই। তাকে খুঁজে বের করতে হবে মৃত্যু থেকে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার উপায়। আর সেই কৌশল ফারাওদের দেশেই পাওয়া সম্ভব।
গত মাস খানেক ধরে দ্য’ শ্যাম্পেন আর ওর ছোট্ট দলটা “মৃতদের শহর” নামে জায়গাটা চষে ফেলছে। এর মাঝে যা কিছু দরকারি মনে হয়েছে সংগ্রহ করেছে-প্যাপিরাসের ওপর লেখা, পাথরে খোদাই বা লিপি যা পেয়েছে সব। যেগুলো সংগ্রহ করতে পারেনি সেগুলো খাতায় এঁকে নিয়েছে।
“আমি বিজ্ঞান ও কলা পরিষদের একজন সদস্য,” দ্য শ্যাম্পেন জবাব দিল। এই পদবীটাই তার পছন্দ।
ভিয়েনেভের তাতে কোনো ভাবান্তর হলো না, “তা আপনি এটা সাথে করে কী নিয়ে এসেছেন, কমিশনার?”
দ্য শ্যাম্পেন নিজেকে সামলালো, “বলা যাবে না, অ্যাডমিরাল। নেপোলিয়নের নির্দেশ ছাড়া এটা ভোলা নিষেধ। ভেতরে কী আছে সেটা নিয়েও আলোচনা করা যাবে না।”
ভিয়েনেভের এবারও কোনো ভাবান্তর নেই। “চাইলেই আবার এগুলো সিল করা যাবে। ঝপপট চাবিটা দিন।”
“অ্যাডমিরাল, জেনারেল কিন্তু ক্ষেপে যাবেন।” সতর্ক করল দ্য শ্যাম্পেন।
“জেনারেল এখানে নেই।” মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল ভিয়েনেভ। নেপোলিয়ন ঐ সময়টাতে খুবই ক্ষমতাধর লোক কিন্তু তখনো সম্রাটের আসনে বসেননি। পাঁচ জনের যে দলটা বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিল, তারাই তখন দেশ চালাচ্ছিল। আর বাকিরা ক্ষমতার লোভে ছোঁক ছোঁক করে বেড়াচ্ছিলো চারপাশে।
কিন্তু তারপরও দ্য শ্যাম্পেন ভিয়েননেভের এমন আচরণের মানে খুঁজে। পেল না। নেপোলিয়ন বা অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েস কেউই হেলাফেলার লোক না। ব্রুয়েস ভিয়েনেভের সরাসরি ওপরওয়ালা বলা যায়। মাত্র আধা মাইল দূরেই তিনি জীবনবাজি রেখে লড়ছেন। আর ভিয়েনেভ এমন নাজুক পরিস্থিতিতে যুদ্ধে যোগ দেয়ার পরিবর্তে এই সামান্য ব্যাপারে কেন মাথা ঘামাচ্ছে?