ওরা সবাই মন্দির ত্যাগ করল। বাচ্চাগুলোর তখনও খিচুনি চলছে। কবে থামবে কে জানে। হয়তো কয়েক সপ্তাহ। এরপর হয়তো আরো কয়েক মাস লেগে যাবে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার ধকল সামলাতে। তবে তততদিনে আখেন আতেনের চোখের জ্যোতি কমতে থাকবে আর ধর্মদ্রোহী ফারাওয়ের রাজত্বও প্রায় শেষ হয়ে যাবে।
.
০১.
আবুকির উপসাগর, নীল নদের মোহনা
১ আগস্ট ১৯৭৮, সন্ধ্যার ঠিক আগে
কামানের গোলার আওয়াজ গমগম করে আবুকির উপসাগরের বিশাল বিস্তৃতি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। আলোর ঝলকানিতে গোধূলি লগ্নটাও আরেকবার আলোকিত হয়ে উঠল। কিন্তু গোলার একটাও জায়গা মতো লাগল না। গরম পানির একটা ঝাঁপটা তুলে তলিয়ে গেল পানিতে। তবে আক্রমণকারী জাহাজগুলো এগিয়ে আসছে দ্রুত পরেরবারের গোলগুলো জলে যাবে না নিশ্চিত। আক্রমণের লক্ষ্য একটা নোঙ্গর ফেলা জাহাজ।
নৌবহরের কিছু সামনেই একটা সাম্পান। ছয়জন সুঠামদেহী ফরাসি নাবিক দাঁড় বাইছে সেটার। যুদ্ধের ঠিক মাঝখানের জাহাজটা লক্ষ করছে ছুটছে সাম্পানটা। অবস্থা দৃষ্টে এটাকে ‘সুইসাইডাল মিশন’ বললেও ভুল হবে না।
“দেরি হয়ে গেছে।“ একজন মাল্লা চেঁচিয়ে বলল।
“বাইতে থাকো। পুরো বহরটাই ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধ শুরু করার আগেই আমাদেরকে লরিয়েন্ট-এ পৌঁছাতে হবে। নাইলে সর্বনাশের বাকি থাকবে না।” দলটার মধ্যে একমাত্র অফিসার আদেশ দিল।
যে নৌবহরটার কথা আলোচনা হচ্ছে সেটা হলো নেপোলিয়নের প্রকাণ্ড ভূমধ্যসাগরীয় নৌ-বহর। সতেরোটা জাহাজ আছে বহরে। এর মধ্যে তেরটাই যুদ্ধ জাহাজ। ইংলিশদের গোলাবর্ষণের বিপরীতে ওরাও জবাব দেয়া শুরু করল। ফলে সূর্য ডোবার আগেই চারপাশ গোলাগুলির ধোঁয়ায় ভরে গেল।
সাম্পানের ঠিক মাঝখানে এক ফরাসি সামরিক ব্যক্তি, নাম এমিল দ্য শ্যাম্পেন। এই মুহূর্তে তাকে হেঁকে ধরেছে মৃত্যু ভয়। লোকটা একজন নামকরা আঁকিয়ে।
যে কোনো মুহূর্তে মারা পড়ার আশংকা না থাকলে দ্য শ্যাম্পেন বর্তমান পরিস্থিতির আনকোরা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতো নিশ্চিত। তার মতো দক্ষ শিল্পীই পারতে বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে নিশ্চল ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে। কীভাবে সামান্য স্কুলিংগ থেকে যুদ্ধের আগুন লাগতে পারে তার পরিপূর্ণ চিত্রায়ণ তার পক্ষেই সম্ভব। কামানের গোলার ভীতিকর আওয়াজ বাতাস কেটে ছুটে যাচ্ছে লক্ষ্য পানে। লম্বা লম্বা মাস্তুলগুলো সেগুলোর আঘাতে কাটা গাছের মতো হেলে পড়ছে। সাদা পানির ধারা কালো আকাশের সাথে গিয়ে মিশেছে। সেখানে হালকা গোলাপি আর নীল রঙের আভা। এই জায়গাটুকু আঁকতে বিশেষ যত্নের দরকার হবে। কিন্তু দ্য শ্যাম্পেন এই মুহূর্তে মাথা থেকে পা পর্যন্ত থরথর করে কাঁপছে। নৌকার একটা পাশ ধরে কোনো মতে কাঁপুনি থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
হঠাৎই একটা গোলা তাদের ঠিক একশো গজ দূরে এসে পড়ল। দ্য চ্যাম্পিয়ন আর চুপ থাকতে পারলো না, “আমাদের দিকে কেন বোমা মারছে?”
“আমাদের দিকে মারছে না।” অফিসার জবাব দিল।
“তাহলে আমাদের এতো কাছে বোমা পড়ছে কেন?”
“ইংরেজ গোলন্দাজ। পশ্চিমে বোমা মারলে পূর্বে গিয়ে পড়ে। এদের নিশানা এতোই খারাপ।”
নাবিকেরা হেসে উঠল। দ্য চ্যাম্পিয়নের অবশ্য হাসি পেল না। নাবিকেরাও ভয় পাচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরেই ওরা ব্রিটিশদের সাথে লুকোচুরি খেলছে। মাস্টার মাত্র এক সপ্তাহ আগু-পিছুর কারণে ধরা পড়েনি, আর আলেকজান্দ্রিয়ার তো মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্যে বেঁচেছে। আর এখন নেপোলিয়নের সৈন্য বাহিনীকে ডাঙ্গায় নামিয়ে দিয়ে যেই বহরটা নীল নদের মোহনায় নোঙ্গর ফেলেছে, তখুনি ইংরেজরা আর তাদের আস্থাভাজন হোরাশিও নেলসন শেষমেশ ওদের সন্ধান পেয়ে গেছে।
“আমার ভাগ্যে যে এরকম শনি আছে, কে জানতো?” দ্য শ্যাম্পেন নিজেকেই নিজে শোনালো। তারপর বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল, “আমার মনে হয় আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত।”
অফিসার মাথা নাড়লো, “আমাকে আপনাকে আর এই ট্রাংকগুলোকে লরিয়েন্টের অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েস-এর কাছে পৌঁছে দেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে।
“আমি জানি আপনাকে কী আদেশ করা হয়েছে। নেপোলিয়ন আদেশটা দেয়ার সময় আমিও সেখানেই ছিলাম।” দ্য শ্যাম্পেন বলল। “কিন্তু এই ভয়ানক গোলাগুলির মাঝে দাঁড় বেয়ে লরিয়েন্টে পৌঁছার বহু আগেই মারা পড়বো সবাই। আমাদের এক্ষুনি ফিরে যাওয়া উচিত। হয় তীরের দিকে না হয় অন্য কোনো জাহাজে।”
অফিসার মাথা ঘুরিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে তাকাল। লরিয়েন্ট বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর শক্তিশালী যুদ্ধ জাহাজ। এটাকে জলদুর্গ বললেও অত্যুক্তি হবে না। প্রায় একশো তিরিশটা কামান আছে এর পাটাতনে। ওজন প্রায় ৫ হাজার টন। হাজার খানেক মানুষ অনায়াসে থাকতে পারে এতে। এটার দুই পাশে সবসময় আরো দুটো ফরাসি যুদ্ধ জাহাজ থাকে। অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েসের মতে এই নিরাপত্তা ব্যুহ ভাঙা অসম্ভব। কিন্তু ব্রিটিশরা সম্ভবত এ খবর জানে না। ওরা ছোট ছোট কয়েকটা যুদ্ধ জাহাজ নিয়েই পূর্ণোদ্যমে বোমা মেরেই যাচ্ছে।
লরিয়েন্ট আর একটা ব্রিটিশ জাহাজ বেলেরফোন একেবারে কাছাকাছি এসে গোলাবর্ষণ করল কিছুক্ষণ। ছোট ব্রিটিশ জাহাজটা প্রায় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। স্টারবোর্ডের রেলিং ভেঙে ঝুলে পড়েছে একপাশে। তিনটা মাস্তুলের মধ্যে দুটোই উপরে পড়েছে। কোনো মতে দক্ষিণে পালিয়ে বাঁচলো সেটা, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আরেকটা জাহাজ এসে বেলেরফোনের শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলল। এর মধ্যেই ব্রিটিশদের ছোট ছোট কয়েকটা রণতরী কম পানির দিকে এগিয়ে গিয়ে (ফরাসি নৌ-বহরের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগল।