“আমার সব সন্তান মারা গেছে। আমি পরকালে তাদের জন্যে ওসাইরিসের আশীর্বাদ চাই।” মানু-হটেপ জবাব দিল।
“কিন্তু তুমি ঐ বিশ্বাসঘাতকদের হয়ে কাজ করো। তুমি ওসাইরিসের আশীর্বাদের যোগ্য নও।” জবাব দিল অবতার। মানু-হটেপ মাথা না তুলেই বলল, “আমার কৃতকর্মের সমস্ত দায় আমার। আখেন আতেনের কথা আমি মেনেছি। তার জন্য আমাকে যা খুশি শাস্তি দিন। কিন্তু যারা মারা গেছে তারা সম্পূর্ণ নির্দোষ। দয়া করে তাদেরকে মুক্তি দিন। আখেন আতেনের অনাচার শুরু হওয়ার আগে এমনটাই করার কথা ছিল।”
বেশ কিছুক্ষণ নীরবেই কাটলো চারপাশ। মানু-হটেপ সাহস সঞ্চয় করে মাথা তুলে তাকাতেই দেখে অবতার তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার কালো চোখে পলক পড়ছে না।
‘না। ওসাইরিস তোমার মুখের কথায় আর গলবেন না। তোমাকে প্রমাণ করতে হবে যে তুমি আসলেই অনুতপ্ত।” শেষমেশ বলল অবতার।
তারপর হাড্ডিসার আঙুল তুলে বেদির ওপর থাকা একটা মাটির পাত্র দেখিয়ে বলল, “ঐ পাত্রে আছে মারাত্মক এক বিষ। কিন্তু এর কোনো স্বাদ নেই। ওটা নিয়ে আখেন আতেনের পানীয়ের সাথে মিশিয়ে দেবে। বিষের প্রভাবে সে অন্ধ হয়ে যাবে। আর কোনোদিন সে চোখ তুলে তার পরম পূজনীয় সূর্যদেবের দিকে তাকাতে পারবে না, ফলে ওর রাজত্বও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।”
“আমার সন্তানদের কী হবে? আমি এই কাজ করলে কী পরকালে ওদেরকে মুক্তি দেয়া হবে?” মানু-হটেপ জিজ্ঞসে করল।
“না” অবতার জবাব দিল।
“কিন্তু কেন? আমিতো ভাবলাম-”
“তুমি যদি এই কাজ করো তাহলে ওসাইরিস আবার তোমার সন্তানদের জীবন ফিরিয়ে দেবেন। তিনি নীল নদকে আবার পুনরুজ্জীবিত করবেন আর তোমাদের ফসলের মাঠ আবার শস্যে ভরে যাবে। বলল, তুমি কী এই প্রস্তাবে রাজি?”
মানু-হটেপ ইতস্তত করতে লাগল। ফারাওয়ের অবাধ্যতা এক জিনিস কিন্তু তাকে হত্যা করা…
ওর দোদুল্যমান অবস্থা দেখে অবতারটা ক্ষেপে গিয়ে হাতের কস্তনিটা বেদির পাশের আগুনে ঠেসে ধরলো। মুহূর্তে অস্ত্রটার চামড়ার ফিতেয় আগুন ধরে গেল। যেন আগে থেকেই তেল মাখানো ছিল ওতে। আগুনটা ভালো মতো ধরতেই হাতের এক মোচড়ে সেটাকে আশে পাশে ছড়িয়ে থাকা শুকনো ভুসি আর পাতার দিকে ছুঁড়ে দিল। সাথে সাথেই সেগুলোয় আগুন ধরে গেল আর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরেই ঘরের জীবিত বা মৃত প্রতিটা মানুষের চারপাশে দেখা গেল আগুন।
তাপের হলকায় মানু-হটেপ পিছু হটলো। ধোঁয়া আর গন্ধে তার চোখে পানি চলে এলো। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে ওর। বহু কষ্টে যখন চোখ খুলল ততোক্ষণে চারপাশে আগুনের উচ্চতা আরো বেড়েছে। আর আগুনের ওপাশেই পুরোহিতবৃন্দ মন্দির ত্যাগ করছে।
“এ তুমি কী করলে?” মানু-হটেপের স্ত্রী বিলাপ করে উঠল।
পুরোহিতরা বেদির অপর পাশের একটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছেন। আগুনের উচ্চতা এখন প্রায় বুক সমান। আর জীবিত বা মৃত সবাইকে ঘিরেই আগুনের শিখা লক লক করছে।
“আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমার ভয় লাগছিল।” বিড়বিড় করে বলল মানু-হটেপ।
ওসাইরিস তাদেরকে একটা সুযোগ দিয়েছিল আর সে কি-না সেটাকে এভাবে পায়ে ঠেললো। প্রচণ্ড মানসিক কষ্ট নিয়ে মানু-হটেপ বেদির ওপরের বিষের পাত্রটার দিকে তাকাল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। ফলে পাত্রটাও চোখের সামনে থেকে আড়াল হয়ে গেল।
চোখে আলো এসে পড়তেই মানু-হটেপের ঘুম ভেঙে গেল। ছাদের ফুটো দিয়ে আলোটা আসছে। আগুন নিভে গেছে তবে চারপাশে গোল হয়ে পড়ে আছে পোড়া ছাই। বাতাসে ধোয়ার গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। মেঝের অন্যান্য জায়গাতেও ছাইয়ের পাতলা স্তর দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। কিছুক্ষণ।
কোনোমতে উঠে বসলো ও। মাথাটা টলছে। বহু কষ্টে চারপাশে তাকাল মাথা ঘুরিয়ে। মন্দিরের দরজা খোলা। সকালের মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা বাতাস আসছে সেদিক দিয়ে। পুরোহিতরা ওদেরকে হত্যা করেনি, কিন্তু কেন?
কারণটা ভাবতে ভাবতেই ছোট ছোট আঙুল ওয়ালা একটা ছোট্ট হাত তার পাশে কাঁপতে দেখা গেল। মাথা ঘুরাতেই দেখলো ওর মেয়ে। ডাঙ্গায় ভোলা মাছের মতো তড়পাচ্ছে। সাথে মুখ একবার খুলছে আর বন্ধ করছে যেন বাতাস ওর ফুসফুসে প্রবেশ করছে না, সেই সাথে হচ্ছে খিচুনি।
মানু-হটেপ ওকে ধরার জন্যে হাত বাড়ালো। অবাক করা ব্যাপার হলো মেয়েটার শরীর আর ঠাণ্ডা নেই, উষ্ণ। শরীরটাও আর শক্ত হয়ে নেই। নরম হয়ে গেছে, সেই সাথে হাত-পা ছুড়ছে। মানু-হটেপের ব্যাপারটা বিশ্বাস হতে চাইলো না। পাশে তাকিয়ে দেখে ওর ছেলেটাও নাড়াচাড়া করছে। যেন স্বপ্নের ভেতর খেলাধুলা করছে।
মানু-হটেপ চেপে ধরে ওর বাচ্চাদের ঝাঁকুনি থামাতে চাইলো কিন্তু কাজ হলো না। ওদের নাম ধরে ডাকলো কিন্তু ওরা সাড়া দিল না।
ওদের আশে পাশের বাচ্চারাও একই দশা নিয়ে জেগে উঠতে লাগল।
“সবার হলোটা কি?” ওর স্ত্রী জিজ্ঞেস করল।
“সম্ভবত ওরা এখন জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি আটকা পড়েছে। কে জানে কতটা কষ্ট হচ্ছে ওদের।” মানু-হটেপ অনুমান করল।
“কী করবো এখন আমরা?”
মানু-হটেপের মাঝে আর কোনো দোটানা নেই, নেই কোনো ইতস্ততবোধ। “আমরা এখন ওসাইরিসের নির্দেশ পালন করবো। ফারাওকে অন্ধ করে দেবো আমরা।”
মানু-হটেপ উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় দৌড়ে গিয়ে বেদিটার কাছে পৌঁছুলো। লাল রঙের বিষের পাত্রটা এখনও আছে। যদিও ওটার রঙ এখন কালো হয়ে গেছে। ও হাত বাড়িয়ে ওটা তুলে ধরলো। এটাই এখন ওর বিশ্বাস আর প্রত্যয়ের একমাত্র অবলম্বন। সমস্ত আশার একমাত্র আধার।