“আপনি আমার সম্পর্কে বেশি উঁচু ধারণা করে ফেলছেন।” কার্ট বলল।
“আমার তা মনে হয় না।” হাত দুটো বুকে ভাজ করে সামনে ঝুঁকে বলল রেনাটা।
সত্যি হোক আর না থোক প্রশংসাটা আন্তরিক। তবে কার্ট এখানে সৌজন্য বিনিময় করতে আসেনি। “দয়া করে মূল কথায় আসুন। ঐ হাতুড়ের দল আমার বন্ধুদের লাশের ওপর কী সব করছে?”
“ঐ হাতুড়েগুলো আমার বন্ধু।” আহতস্বরে বলল ডা. আমব্রোসিনি। “ওরা অন্তত বেঁচে আছে।”
ডা. আমব্রোসিনি একটা বড় শ্বাস নিলো, সে ঠিক করছে কতটুকু বলবে। তারপর শ্বাস ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ। আমি বুঝতে পারছি যে আপনার মন অনেক খারাপ। আপনার বন্ধুরা আর দ্বীপের সবাই মারা গেছে। কিন্তু আমাদেরকে তো খুঁজে দেখতে হবে”।
“কোন ধরনের বিষ সবাইকে মেরেছ?” বাক্যটা শেষ করল কার্ট।
“খুব ভালো প্রস্তাব। বুঝলাম সেটা। কিন্তু আমি যদূর জানি সেগুলো করা হয় রক্ত বা কোষ পরীক্ষা করে। আর সবচে বেশি দরকার হলো ঐ পোড়া জাহাজটা থেকে আসা ধোয়াটা পরীক্ষা করা। আসল ব্যাপারটা পরিষ্কার করুন। নাহয় ওসব ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো যে চিকিৎসা আপনারা দিচ্ছেন তা বন্ধ করুন।”
“ডা. ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের চিকিৎসা! আরে আমরা তো সেটাই করার চেষ্টা করছি।”
কার্ট ধরতে পারলো না কথাটা, “মানে? কেন?”
“কারণ, আমরা আবারো আপনার বন্ধুদেরকে জীবিত করে তোলার চেষ্টা করছি।” শান্তস্বরে জবাব দিল ডা. আমব্রোসিনি।
.
১২.
কার্ট এতোই অবাক হয়েছে যে কিছুক্ষণ কথা বের হলো না মুখ দিয়ে। “কি বললেন?” কোনোমতে বলল ও।
“আপনার বিস্ময় দেখে অবাক হচ্ছি না। ডা. রাবিশ্ব কি বললেন খেয়াল নেই! আজকের ব্যাপারটা একদমই আলাদা। রেনাটা বলল।
“এ তো স্রেফ পাগলামি। ওঝাদের মতো মন্ত্র পড়ে নিশ্চয়ই আপনারা আবার এতোগুলো মানুষকে জীবন দান করবেন না।” কার্ট জবাব দিল।
“আমরা পিশাচ না। ব্যাপারটা হলো এখানকার লোকগুলো এখনও মারা যায়নি। অন্তত এখনও না। তাই আমরা কোমর বেঁধে চেষ্টা করছি লোকগুলোর জ্ঞান ফেরানোর জন্য।”
কার্ট কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখলো কথাটা। তারপর বলল, “আমি নিজে কয়েজনকে পরীক্ষা করে দেখেছি।” ওরা কেউ নিশ্বাস নিচ্ছিলো না। আর ইতালিয়ান মিলিটারি আসার আগে আমি হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঢু মেরেছিলাম। অনেক রোগীর গায়েই EKG মেশিন লাগানো ছিল কিন্তু কোনোটাতেই হার্ট বীট দেখাচ্ছিলো না।”
“হ্যাঁ আমি জানি। সত্যি কথা হলো তারা নিশ্বাস নিচ্ছে, তাদের হার্টও সচল। ব্যাপার হলো তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস এখন মারাত্মক রকম হালকা আর ধীর। নিশ্বাস পড়ছেও অনেকক্ষণ পরপর। দুই মিনিটে হয়তো একবার শ্বাস নিচ্ছে। হার্ট রেট কমে এসেছে এক অঙ্কের ঘরে। আর নিলয়ের সংকোচন এতোই দুর্বল যে কোনো সাধারণ মনিটরে সেটা ধরা পড়বে না।”
“সেটা কীভাবে সম্ভব?”
“এরা আসলে এক ধরনের কোমায় চলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে এই ধরনের কোমা চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য সম্পূর্ণ নতুন। এমনিতে কোমা হলে ব্রেনের কয়েকটা অংশের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। শুধু একদম ভেতরের দরকারি অংশগুলো সক্রিয় থাকে। ধারণা করা হয় যে শরীর নিজেকে রক্ষা করতে কাজটা করে। রোগী যেহেতু সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকে, তাই শরীর বা ব্রেন যেখানেই সমস্যা থাকুক সেটা একা একাই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এই লোকগুলোর ব্রেন বন্ধ হয়নি। সব অংশই কাজ করছে কিন্তু কোনো ওষুধ বা উদ্দীপনা কোনো কিছুতেই সাড়া দিচ্ছে না।”
“আরেকটু সহজভাবে বলা যাবে?”
“মানে তাদের ব্রেনে কোনো ক্ষতি হয়নি, কিন্তু তারা জেগে উঠতে পারছে না। ধরেন একটা কম্পিউটারকে কেউ স্টান্ড বাই বা স্লীপ মুড-এ রেখে দিল কিন্তু আবার চালু করার জন্য যত টেপাটিপিই করুক, কম্পিউটার অন হলো না। এদের অবস্থা ঠিক সে রকম।”
কার্ট মানব শারীরতত্ত্বের খুব সামান্যই জানে। তাই নিজে নিজেই কোনো উপসংহারে পৌঁছার ঝুঁকি নিলো না। আগে ব্যাপারটা পুরোপুরি পরিষ্কার হতে চায়। “যদি ওদের হার্ট এতো আস্তেই চলে আর ঠিকমতো রক্ত সরবরাহ করতে না পারে আবার নিশ্বাসও প্রায় বন্ধই বলা যায়, তাহলে কি ওদের শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হবে না? এতে তো ব্রেন ড্যামেজ হওয়ার কথা।”
“হতেও পারে। তবে আমাদের ধারণা ওরা আসলে জীবন আর মৃত্যুর মাঝ খানে ঝুলে আছে। শরীরের তাপমাত্রা খুবই কম, শরীরের বিপাকীয় হারও কম তার মানে তাদের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খুবই কম মাত্রায় অক্সিজেন ব্যবহার করছে। এজন্যেই এত ধীর নিশ্বাস বা দুর্বল হার্ট-বীটেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। অক্সিজেন যেটুকু আছে তাতেই চলে যাচ্ছে, ব্রেনেরও ক্ষতি হচ্ছে না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পানিতে ডুবন্ত কোনো মানুষকে উদ্ধারের পর তাকে দেখেছেন কখনো?”
কার্ট মাথা ঝাঁকালো, “বছরখানেক আগে আমি একটা ছেলে আর ওর কুকুরকে বরফ হয়ে যাওয়া একটা লেক থেকে উদ্ধার করেছিলাম। কুকুরটা একটা কাঠবিড়ালিকে তাড়া করে বরফের ওপর উঠতেই পা আটকে যায়। ছেলেটা কুকুরটাকে উদ্ধার করতে গেলে বরফ ভেঙে দুজনেই পড়ে যায়। উদ্ধার করার পর দেখি ছেলেটার সারা শরীর নীল হয়ে গেছে। সাত মিনিটের মতো পানির নিচে ছিল সে। এতোক্ষণ পানিতে থাকলে তো বাঁচার কথা না। কুকুরটাও মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু প্যারা মেডিকগুলো দুজনকেই সুস্থ করে ফেলেছিল। ছেলেটা পুরো সুস্থ হয়ে গিয়েছিল। ব্রেন-ট্রেন কিছুই ড্যামেজ হয়নি। এখানেও কি একই ব্যাপার নাকি?”