আরো দুটো সিঁড়ি আর বেশ কিছু গলি-ঘুপচি পেরিয়ে সামনের দুজন একটা হ্যাঁচের আড়ালে অদৃশ্য হলো।
কার্টও দরজাটার পাশে দাঁড়ালো। বাইরে থেকে দেখে তো এটাকেও একটা স্টোর রুম মনে হচ্ছে ওর কাছে। ভেতরে কি আছে দেখার জন্য। দরজাটা একটু ফাঁক করতেই বুঝতে পারলো ওর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।
সামনে গুহার মতো বিশাল একটা রুম। ওপরে সারি সারি বাতি জ্বলছে। এটা সম্ভবত জাহাজের মালপত্র রাখার জায়গা তবে এখন এখানে কোনো মালপত্র নেই। তার বদলে শত শত লাশ শুয়ে আছে মেঝেতে। খাটের ওপরও দেখা গেল কয়েক জনকে। কারো পরনে বেদিং স্যুট, যেন সমুদ্রের তীর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ওগুলো। অন্যদের পরনে সাধারণ পোশাক। কারো কারো পরনে একেবারে অফিসিয়াল পোশাক। যেন অফিসে এসে ঘুমিয়ে পড়েছে।
কার্ট দরজাটা পুরো খুলে ভেতরে পা দিল। এতো লাশ দেখে অবশ্য যতটা অবাক হওয়ার কথা ও ততটা হয়নি। কারণ লাশগুলোকে সরাতেই হতো। আর সারাদিনই দেখেছে জাহাজ থেকে হেলিকপ্টার দ্বীপটায় যাচ্ছে আর আসছে। বেশ কয়েকজনের হাতে-পায়ে দেখা গেল তার-টার হাবিজাবি লাগানো। সেগুলো আবার লাগানো একগাদা মনিটর আর অন্যান্য যন্ত্রপাতিতে। কারো কারো হাতে স্যালাইন লাগানো। কাউকে কাউকে খোঁচাখুঁচি করছে ডাক্তাররা। একজনের শরীরে কারেন্টের লাইন দিতেই কাঁপাকাপি শুরু হয়ে গেল। কিন্তু কারেন্ট থামাতেই আবার যেই কে সে-ই। নড়াচড়া নেই।
প্রথমে কেউ-ই কার্টকে খেয়াল করল না। কারণ ওর পরনে এই জাহাজের ক্রুদের মতো পোশাক আর সবাই যার যার কাজে ভীষণ ব্যস্ত। আরো সামনে এগোতেই ওর চোখে পড়ল কডি উইলিয়াম আর আরো দুজন NUMA-র লোকের লাশ। কার্ট সামনে এগিয়ে গেল। একজনকে একটা ইনজেকশন দেয়া হচ্ছে। তার মাথাতেও তার লাগানো কাউকে কারেন্টের শক দেয়া হচ্ছে।
“আরে আরে করছেন কি?” কার্ট চেঁচিয়ে উঠল।
ঘরের বেশিরভাগ চোখ ওর দিকে ঘুরে গেল। মুহূর্তেই সবাই বুঝে গেল যে ও এখানকার কেউ না। “কে আপনি?” একজন জিজ্ঞেস করল।
“তার আগে বলেন আপনারা কারা? আর লাশের ওপর এসব কি শুরু করেছেন?” আগের চেয়েও জোরে চেঁচালো কার্ট।
কার্টের চড়া আওয়াজ পুরো রুম জুড়ে প্রতিধ্বনিত হলো। হঠাৎ এর এমন রাগে বাকি সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে। শুধু দু-একজনকে দেখা গেল ফিসফিস করে পাশের জনের সাথে কথা বলছে। কেউ মনে হলো জার্মান ভাষায় কি বলছে। হঠাৎ একজন চেঁচালো, “সিকিউরিটি?”
সাথে সাথে কয়েকজন মিলিটারি পুলিশ চলে এলো।
“আপনি যে-ই হন, এখানে থাকতে পারবেন না,” একজন ডাক্তার বলল। অদ্ভুত উচ্চারণে ইংরেজি বলছে লোকটা। তবে টানটা ইতালিয়ান না, ফ্রেঞ্চ সম্ভবত।
“ওনাকে এখান থেকে নিয়ে যান।” আরেকজন বলল। এর উচ্চারণ শুনেও অবাক হলো। মনে হচ্ছে এর বাড়ি কানসাম বা আইওয়া।
কিন্তু কার্ট এসব কথাকে পাত্তা না দিয়ে NUMA-র লোকটার দিকে এগুলো। কি করছে আসলে ওরা কাছে থেকে দেখতে চায়। কিন্তু সিকিউরিটিরা বাধ সাধলো। ওদের হাতে লাঠি। কোমরে গোজা টীজার (কারেন্টের শক দেয়ার যন্ত্র)।
“বের করে ব্যাটাকে। আর দয়া করে একটু পাহারা দেয়ার দিকে মন দাও। এরকম হতে থাকলে কাজ করবো কীভাবে?” বলল আরেকজন।
কার্ট যাওয়ার জন্যে ফিরতেই একটা মহিলা কন্ঠে বলে উঠল, “আরে করেন কি? হিরো-কে কেউ এভাবে সম্ভাষণ জানায়?”
কথাগুলো ইংরেজিতে বলা কিন্তু ইতালিয়ান টান আছে। ব্যঙ্গ করে বলা হলেও কথাটায় কর্তৃত্বের সুর স্পষ্ট। কথাগুলো বলেছে ডা. আমব্রোসিনি। সামান্য ওপরে একটা মঞ্চমত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে।
একজন নর্তকীর মতো মোহনীয় ভঙ্গিমায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো রেনাটা।
“কিন্তু ভা, আমব্রোসিনি…” বিদেশি একজন ডাক্তার বাধা দিতে গেলেন।
“কিন্তু কিছু না ডা. রবিশ্ব। লোকটা আমার জীবন বাঁচিয়েছে, আমি বাদে আরো আঠারো জনের জীবন বাঁচিয়েছে আর আমাদের তদন্তের শুরু থেকে এই সমস্যার উৎস সম্পর্কে সবচে বড় কু-ও সে-ই দিয়েছে।”
“আজকের পরিস্থিতিটা কিন্তু সম্পূর্ণ অন্যরকম।” ডা. রবিশ্ব বললেন।
“হ্যাঁ, আমি জানি।” ডা. আমব্রোসিনি জবাব দিলেন।
কার্ট ব্যাপারটায় মজা পেল। ডা. রেনাটা পুরোপুরি সিঁড়ি থেকে নামতেই দেখা গেল রুমের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে খাটো। কিন্তু সে-ই যে বস সেটাও বোঝা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে কার্টকে দেখে আসলেই খুশি হয়েছে। তবে এই সামান্য মুচকি হাসি আর কটাক্ষে কার্টের মন গলবে না।
“এখানে আসলে হচ্ছেটা কি?” জিজ্ঞেস করল কার্ট।
“একা একা কথা বলি চলুন।” ডা. আমব্রোসিনি প্রস্তাব দিল।
“সেটাই ভালো। চলুন।”
ডা. আমব্রোসিনি কোণার একটা অফিস রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। কার্টও গেল পিছনে। রুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিল।
রুমটা আসলে জাহাজের কোয়ার্টার মাস্টারের জন্যে বানানো। এখন সেটা ডাক্তারদের ব্যবহার উপযোগী বানানো হয়েছে।
“প্ৰথমত, আমি আপনাকে আমার জীবন বাঁচানোর জন্যে ধন্যবাদ দিতে চাই।” ডা. আমব্রোসিনি শুরু করলেন।
“এই মাত্র আপনিও একই কাজ করেছেন।”
ডা. আমব্রোসিনি হাসলো। তারপর মুখের সামনে এসে পড়া এক গোছা অবাধ্য চুল কানের পিছনে খুঁজে বলল, “আমি আপনাকে কিছু থেকেই বাঁচাইনি। আমার ধারণা আমি ওই পুলিশগুলোকে বরং মার খেয়ে অপমান হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছি।”