রেনাটার বাড়ি টুসকানি-তে। তবে ইতালির অনেক জায়গাতেই ওর থাকা পড়েছে। বাবা ছিলেন ইতালির মিলিটারি পুলিশ দলের একজন বিশেষজ্ঞ। তার সাথেই সারা দেশ ঘুরেছে। এক সন্ত্রাসী হামলায় মা মারা যান। রেনাটার বয়স তখন মাত্র পাঁচ। তারপরই তার বাবা সারা দেশ ঘুরে ঘুরে সংগঠিত সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশেষ বাহিনী তৈরির কাজে মনোযোগ দেন।
বাবার কাছ থেকে পেয়েছে সাহস আর জেদ এবং মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে সৌন্দর্য। রেনাটা বৃত্তি পেয়ে মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হয় এবং প্রথম স্থান নিয়েই পড়াশোনা শেষ করে। সাথে পার্টটাইম পেশা হিসেবে ছিল মডেলিং। তবে শেষ পর্যন্ত বিলবোর্ডের চেয়ে ইমার্জেন্সি রুমই বেশি মনে ধরে যায়। কারণ মডেল-এর জীবন হলো অন্যদের কাছ থেকে সমালোচনা পেয়ে পেয়ে বেঁচে থাকা, যেটা ওর খুব একটা পছন্দ না। আর তাছাড়া চেহারা ভালো হলেও অন্যান্য মডেলদের তুলনায় রেনাটা কিছুটা খাটো। মাত্র পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি।
অন্যরা যাতে তাকে সিরিয়াসলি নেয় তাই রেনাটা চুল সবসময় কালো রঙ করে রাখতে, বেশি একটা মেক আপ দিতো না, এমনকি মাঝে মাঝে গাম্ভীর্য আনার জন্য চোখে একটা চশমাও লাগাতো। তারপরেও এই চৌত্রিশ বছর বয়সেও জলপাই তেলের রঙের মসৃণ চামড়া আর সোফিয়া লরেনের মতো দেহ সৌষ্ঠবের কারণে তার পুরুষ সহকর্মীরা সুযোগ পেলেই আড়ালে আবডালে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো।
সে কারণে ও সিদ্ধান্ত বদল করে ঠিক করে ডাক্তারিই করবে। এ কারণেই ল্যাম্পেডুসাতে আগমন। আর এখানেই ও আবিষ্কার করে ওর আসল সত্তা, ও আসলেই কি চায়। তবে এখন অবশ্য ও জানে না এখান থেকে বেঁচে আর ফিরতে পারবে কি-না।
“আরেকটু ধৈর্য ধরো।” নিজেকেই বলল রেনাটা।
ও আরো একবার কার্বন-ডাই-অক্সাইড দূষিত বাতাসে শ্বাস গ্রহণ করল। বুকে মনে হলো আগুন ধরে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকাল একবার। আমেরিকান লোকটার সাথে কথা হয়েছে এখনো দশ মিনিট হয়নি।
“এতক্ষণ লাগছে কেন?” রেনাটার পাশ থেকে তরুণ একজন ল্যাব সহকারী জিজ্ঞেস করল।
“এলিভেটর নষ্ট হয়ে গেছে বোধহয়।” ব্যঙ্গ করে বললে রেনাটা। তারপর বহু কষ্টে নিজেকে টেনে তুললো। অন্যদের চেক করবে।
আক্রমণটা শুরু হতেই ওরা এই রুমের কজন-ই শুধু বাঁচতে পেরেছে। এখানে আছে একজন নার্স, একজন ল্যাব-সহকারী, চারটা বাচ্চা আর বারোজন বয়স্ক রোগী। এর মধ্যে তিনজন বিদেশি। তিউনিসিয়া থেকে একটা ভাঙ্গচোরা নৌকায় করে এখানে চলে এসেছে। আসার পথে জ্বলন্ত সূর্যের তাপে গায়ে ফোস্কা পড়েছে, একটা ঝড়ের কবল থেকে বেঁচেছে। দ্বীপের কাছে পৌঁছে শেষ মুহূর্তে হাঙ্গরের আক্রমণ থেকে বাঁচতে পাঁচশো গজ সাঁতরে তীরে এসে উঠেছে। এতো মারাত্মক সব জিনিস থেকে বেঁচে এসে এখন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বিষক্রিয়ায় মারা যাচ্ছে। ভাগ্য! তাও একটা হাসপাতালের রুমে যেখানে তাদের অক্সিজেন আরো বেশি পাওয়ার কথা।
বেশ কয়েকজন রোগী-ই ইতোমধ্যে অচেতন হয়ে গেছে। সর্বশেষ অক্সিজেনের বোতলটা নিয়ে খুললো রেনাটা। কিন্তু কিছুই বেরুলো না। খালি।
বোতলটা হাত থেকে ফেলে দিল ও। প্রচণ্ড শব্দ করে সেটা একদিকে গড়িয়ে দেয়ালে গিয়ে থামল। কেউ একবার চোখ ঘুরিয়েও দেখলো না। বাকিরাও জ্ঞান হারাচ্ছে। জ্ঞান আর ফিরবে কি-না জানা নেই। আর কিছুক্ষণ। অক্সিজেন না পেলেই ব্রেইন ড্যামেজ হয়ে পুরোপুরি চিরনিদ্রায় ঢলে পড়বে সবাই। রেনাটা দরজার কাছে গিয়ে হেলান দিল। আর পারছে না। টেপ ধরে টান দিল। কিন্তু এতোটাই দুর্বল যে টেপটাও খুলতে পারলো না। “শক্ত হও রেনাটা, শক্ত হও।” নিজেকেই নিজে আদেশ দিল রেনাটা।
ঘরের ভেতর মনে হলো একটা কমলা রঙের অস্পষ্ট কিছু বোধহয় পিছনের ঘরটায় ঢুকেছে। একটা মানুষ। আজব একটা পোশাক পরনে। রেনাটার মনে হলো লোকটা নভোচারী। নাকি লোকটা এলিয়েন? নাকি পুরোটাই চোখের ভুল? হঠাৎ লোকটা চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার মানে ওটা চোখের ভুল।
আবার টেপের কোণাটা ধরলো রেনাটা। টান দেবে তখনি শোনে কেউ বলছে, “না।”
রেনাটা ছেড়ে দিল টেপ। সাথে সাথেই হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল, তারপর কাত হয়ে গেল একপাশে। শুয়ে শুয়েই দেখলো দরজার নিচের পাস্টিক ফুটো করে সরু একটা নল ঢুকে গেল। তারপর সেটা সাপের মতো হিসহিস করে উঠল। প্রথমে ভাবলো এটা বুঝি সাপ-ই কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরই ওর মাথা পরিষ্কার হয়ে এলো। অক্সিজেন-তাজা অক্সিজেন টুকছে ভেতরে।
প্রথমে ধীরে ধীরে তবে তারপরই আচমকা সব জড়তা কেটে গেল রেনাটার। মাথাটা অবশ্য টনটন করে উঠেছে, তবে ও এতেই খুশি। বুক ভরে নিশ্বাস নিলো ও। ঠাণ্ডা অক্সিজেন একেবারে শরীরের সবচে ভেতরের কোষটা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। রক্তে আবারো বইতে শুরু করেছে অ্যাড্রেনালিন, ঠিক একজন দৌড়বিদের সমান।
আরেকটা নল ঢুকতে দেখা গেল পাশেই। রেনাটা একপাশে সরে গেল যাতে অন্যদের কাছে দ্রুত অক্সিজেন পৌঁছায়। শরীরে কিছুটা শক্তি ফিরে পেতেই রেনাটা উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে চোখ রাখলো। কমলা রঙের নভোচারীকে দেখা গেল। ইন্টারকমের দিকে যাচ্ছে। এক সেকেন্ড পরই রেনাটার ঠিক পাশেই ঝোলানো স্পিকারটা জ্যান্ত হয়ে উঠল, “সবাই ঠিক আছে তো?”
“আশা করি ঠিক থাকবে। আপনার মাথায় কি হয়েছে? রক্ত পড়ছে।”