“আমার মনে হয় আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। কেন যেন মনে হচ্ছে ভুল করছি আমরা।” মানু-হটেপের স্ত্রী বলল।
“আখেন আতেনের সব কথা মেনে নেয়াটা ছিল ভুল।” মানু-হটেপ জবাব দিল। “ফারাও একজন ধর্মদ্রোহী। আর তার সাথে তাল মিলানোর কারণেই আজ ওসাইরিস আমাদের শাস্তি দিচ্ছেন। শুধু আমাদের আমরা যারা আখেন আতেনকে সমর্থন দিয়েছি তাদের প্রত্যেকের সন্তান মারা পড়ছে, আমাদের গবাদি পশু সব মরে সাফ হয়ে যাচ্ছে। আমাদেরকে ওসাইরিসের কাছে মাফ চাইতে হবে। আজই। এক্ষুনি। আর দেরি করা যাবে না।”
কথাগুলো বলতে বলতে মানু-হটেপের সংকল্প আরো দৃঢ় হলো। এতদিন আখেন আতেনের বিরুদ্ধে কেউ বলতে গেলেই তাকে জোর করে থামিয়ে দেয়া হয়েছে, চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে তাদের কণ্ঠ। কিন্তু দেবতারাও ক্ষেপে গেছে। ফলে দেশ জুড়ে এখন নিষ্ঠুর গজব চলছে। এর মধ্যে যারা আখেন আতেনের সহযোগী ছিল তারা ভুগছে সবচে বেশি।
“এদিক দিয়ে।” বলে মানু-হটেপ পা বাড়ালো।
কিছুক্ষণ পরেই দলটা শহরের আরো ভেতরে সবচেয়ে বড় দালানটার সামনে এসে পৌঁছুলো। এটাই ওসাইরিসের মন্দির।
মন্দিরের ছাদটা বিশাল, অবশ্য কোনো গম্বুজ নেই, সমতল। বিশাল বিশাল গ্রানাইটের পাথর থেকে লম্বা লম্বা থাম উঠে গেছে ওপরে। তার মাঝ দিয়ে চওড়া একটা সিঁড়ি। একটা নকশা কাটা পাথরে গিয়ে সেটা থেমেছে। পাথরটায় ইথিওপিয়ার লাল মার্বেল, আর ইরানের নীলকান্তমণি বসিয়ে পাথরটায় নকশা করা হয়েছে। তার পরেই ব্রোঞ্জের তৈরি দৈত্যাকৃতির দুটো দরজা।
মানু-হটেপ দরজার কাছে পৌঁছে ঠেলে খুলে ফেলল। কেমন শান্তি-শান্তি লাগছে তার। তবে দরজা খোলামাত্র একটা পুঁতি গন্ধ এসে নাকে লাগতেই শান্তি উবে গেল। মানু-হটেপ আরা অবাক হলো যখন দেখলো মন্দিরের বেদি আর দেয়াল জুড়ে মশাল জ্বলছে। মশালের মিটিমিটি আলোয় চোখে পড়ল মন্দিরের মাঝে অর্ধবৃত্তাকারে কিছু বেঞ্চ জড়ো করে রাখা। তার ওপর মৃত লাশ রাখা। পুরুষ, মহিলা আর শিশুর লাশ, সবই আছে। আর তার চারপাশে মৃতদের পরিবারের লোকেরা দাঁড়ানো। থেমে থেমে ফেঁপাচ্ছে আর বিড় বিড় করে প্রার্থনা করছে।
“তার মানে শুধু আমরাই আখেন আতেনের ফরমান ভঙ্গ করে এখানে আসিনি।” মানু-হটেপ বলল।
মন্দিরের ভেতরের মানুষগুলো ওর দিকে তাকাল, কিন্তু কারো মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ করা গেল না।
“তাড়াতাড়ি করো” হটেপ ভৃত্যদের আদেশ দিল।
একে একে সব ভৃত্য লাশগুলো সারি করে সাজিয়ে রাখলো। আর মানু হটেপ ওসাইরিসের প্রকাণ্ড বেদিটার সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। তারপর মাথা নিচু করে শুরু করল প্রার্থনা। চাদরের ভেতর থেকে দুটো উটপাখির পালক বের করল মানু-হটেপ। তারপর ফিসফিস করে বলল, “হে মৃতদের প্রভু! হে মহানুভব, আমরা বড় বিপদে পড়ে আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। আমাদের পরিবারের সদস্য সকলে জরাগ্রস্ত হয়ে গিয়েছে, আমাদের ঘরবাড়িগুলো অভিশপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে, আমাদের ফসলের জমিগুলো বিরান হয়ে গিয়েছে। আজ শুধু একটাই প্রার্থনা, আমাদের মধ্যে যারা মৃত, তাদের আত্মাকে আপনি গ্রহণ করুন, তাদের পরকালকে আপনার আশীর্বাদে ধন্য করুন। আপনিই জীবন মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক, আপনার আদেশেই মৃত বীজ থেকে আবার জীবন উৎসরিত হয়। আমরা আপনার কাছে কড়জোরে মিনতি করছি, আমাদের মাঠকে আবার ফসলে ভরিয়ে দিন, আমাদের বাড়িগুলোকে অভিশাপ মুক্ত করুন।”
তারপর বিনম্রভাবে পালক দুটোকে নামিয়ে রাখলো আর তার চারপাশে স্বর্ণমিশ্রিত বালু ছড়িয়ে দিয়ে বেদি থেকে নেমে এলো।
হঠাৎ দমকা বাতাস বয়ে গেল মন্দিরের ভেতর। মশালের আগুন তাতে একদিকে কাত হয়ে গেল। সাথে সাথেই বুম করে একটা শব্দ মন্দিরের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পড়ল।
মানু-হটেপ সাথে সাথেই পিছনে ঘুরলো। দূরে দেখা যাচ্ছে প্রকাণ্ড দরজা দুটো বন্ধ হয়ে গেছে। তাতেই শব্দটা হয়েছে। ও নার্ভাস ভঙ্গিতে চারপাশে একবার তাকাল। মশালের আলো একদমই কমে এসেছে। যে কোনো সময় নিভে যাবে। তবে সেই আলো চোখে সয়ে আসতেই মানু-হটেপ খেয়াল করল বেদির ঠিক পিছনেই বেশ কয়েকটা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। মুহূর্ত আগেও সেখানে কেউ ছিল না।
চারজনের পরনে স্বর্ণখচিত কালো পোশাক–ওসাইরিসের কাল্টের পুরোহিত এরা। পঞ্চমজনের পোশাক সম্পূর্ণ আলাদা। ভাবগাম্ভীর্যে মনে হচ্ছে, সে-ই বুঝি পরকালের দেবতা স্বয়ং। পা আর কবজির চারপাশে মমি করার কাপড় দিয়ে মোড়া গলা আর হাত ভর্তি স্বর্ণের অলঙ্কার আর মাথায় উটপাখির পালক খচিত একটা মুকুট।
অবয়বটার ডান হাতে একটা ভেড়া তাড়ানোর ছড়ি অপর হাতে একটা স্বর্ণের কস্তনি। যে এখুনি সেটা দিয়ে ধান মাড়াই আরম্ভ করবে। “আমি ওসাইরিসের দূত। পরকালের মহান প্রভুর অবতার।” পুরোহিতটা বলল অবশেষে।
গমগমে কণ্ঠস্বরটা শুনলেই বোঝা যায় যে সেটা পার্থিব দুনিয়ার কারো না। মন্দিরের ভেতরকার সবাই মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানালো। তারপর পুরোহিতবৃন্দ একসাথে সামনে এগুলো। মৃতদের পাশে এসে তারা পাতা, ফুলের পাপড়ি আর কি একটা ছিটাতে লাগল। শেষ জিনিসটা মানু-হটেপের কাছে মনে হলো কোনো ধরনের সরীসৃপ বা উভচরের শুকনো চামড়ার ফালি।
“তুমি ওসাইরিসের কাছে আশ্রয় চেয়েছ?” অবতার বলল।