তবে আসল ঝামেলা শুরু হয় ঠিক এর পরেই। বিস্ফোরণে ধ্বংস হওয়ার বদলে হিমাঙ্কের নিচে থাকা ঠাণ্ডা তরলটা উল্টো একটা নার্ভ গ্যাসের ধোয়া সৃষ্টি করে বসেছে। লোকটা অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখলো প্রাণঘাতী কুয়াশাটা ধীরে ধীরে পশ্চিমে এগিয়ে পুরো দ্বীপটাই ছেয়ে ফেলল। সে আর তার উচ্চপদস্থরা যে জিনিসটা গোপন রাখার এতো চেষ্টা করছিল সেটাই এখন সারা দুনিয়ায় জানাজানি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
রেডিওর সাহায্যের আবেদনটা সে-ও শুনেছে। কলটা করেছে দ্বীপের একজন ডাক্তার। সে এবং কয়েকজন রোগী একটা হাসপাতালে আটকা পড়েছে। পরিষ্কার শুনেছে মহিলা একটা গ্যাসের মেঘের কথা বলছে।
তখনই চরম সিদ্ধান্তটা সে নিয়ে নিয়েছে। ডাক্তারকে বেঁচে থাকতে দেয়া চলবে না। সেই সাথে নষ্ট করতে হবে তার উদ্ধার করা সমস্ত প্রমাণাদি।
পকেট থেকে একটা হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ বের করল সে। ওতে আগে থেকেই ওষুধ ভরা। দাঁত দিয়ে সুঁইয়ের ক্যাপ খুললো, তারপর আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে নিশ্চিত হলো যে সিরিঞ্জে কোনো বুদবুদ নেই। তারপর পায়ে ইঞ্জেকশনটা ঢুকিয়ে দিল। এটা একটা প্রতিষেধক। সারা শরীরে একটা ঠাণ্ডা স্রোত ওষুধটার সাথে সাথে উঠে এলো। হাত-পা কেমন অবশ হয়ে এলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার সব স্বাভাবিক হয়ে এলো। লোকটা জোডিয়াকটার মোটর চালু করে দ্বীপের দিকে রওনা দিল। তারপর সুবিধামতো একটা জায়গায় সেটাকে আটকে রেখে নেমে এলো বালিয়াড়িতে।
কিছুক্ষণের মাঝে ও বালিয়াড়ি ছাড়িয়ে একটা পাথরের সিঁড়ির গোড়ায় এসে পৌঁছুলো। সিঁড়ির শেষ মাথা থেকে শুরু হয়েছে একটা পাকা রাস্তা।
হাসপাতাল এখান থেকে দুই মাইল দূরে। এয়ারপোর্টের কাছেই। লোকটার পরিকল্পনা হলো, সে ডাক্তার আর বাকি জীবিত লোকদের খুন করবে, তারপর এয়ারপোর্টে গিয়ে একটা ছোট বিমান চুরি করে তিউনিসিয়া বা লিবিয়া বা পারলে মিসরে পালিয়ে যাবে। কাক পক্ষীতেও ওর কথা জানতে পারবে না।
.
০৬.
“নাহ! জিনিসটা তো শান্তি দিচ্ছে না একদমই,” জো বলল।
জিনিসপত্রসহ একেবারে পুরো ডুবুরির পোশাকটাই ওর পরনে। ওপরে জ্বলছে কড়া সূর্য। ফলে গরমে ঘেমে চরম অস্বস্তিকর একটা অবস্থায় পড়ে গেছে ওরা। কেমন একটা দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছে ওদের। বাতাস আছে। কিন্তু স্যুটের পুরু কাপড় ভেদ করে সেটা চামড়ায় পৌঁছুতে পারছে না।
“বিষাক্ত ধোয়া খেয়ে মরার চেয়ে অন্তত ভালো। কার্ট বলল।
জো মাথা ঝাঁকিয়ে আবার সামনে নজর দিল। এই মুহূর্তে ওরা ল্যাম্পেডুসা বন্দর রক্ষা বাঁধ পার হচ্ছে। কয়েক ডজন ছোট ছোট নৌকা এখানে সেখানে বাঁধা। অপরূপ নৈসর্গিক পরিবেশ চারপাশে।
“একটা নৌকাতেও কেউ নেই।” জো বলল।
কার্ট পানি ছাড়িয়ে রাস্তা আর দালানগুলোর দিকে তাকাল, “সামনের রাস্তাও জনমানব শূন্য। গাড়ি তত দূরে থাক একটা পথচারীও নেই।”
ল্যাম্পেডুসার জনসংখ্যা মাত্র পাঁচ হাজার, কিন্তু কার্ট খেয়াল করেছে এর মধ্যে অনেককেই পাওয়া যাবে মেইন রোডে। বিশেষ করে যখনই ওর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হয়। স্কুটার আর ছোট ছোট গাড়ি ভটভট করতে করতে বিভিন্ন দিকে ছুটছে, এদের সাথে ছোট ছোট ডেলিভারি ট্রাকগুলো আবার প্রতিযোগিতায় নামে। শশা শো করে কারো তোয়াক্কা না করে পাশ কাটাচ্ছে। ভাবটা এমন যে এখানকার কমপক্ষে অর্ধেক মানুষ ফর্মুলা ওয়ানের ড্রাইভার হওয়ার যোগ্য।
এ রকম সরগরম একটা দ্বীপের এরকম নিস্তব্ধতায় ওঁর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। “ডান দিকে যাও। ঐ মাছধরা নৌকাটার পাশ দিয়ে। তাহলে শর্টকাটে যাওয়া যাবে।” কার্ট বলল।
“শর্টকাট?”
“ওদিকে একটা প্রাইভেট সিঁড়ি আছে। ওটা আমাদের বিল্ডিং-এর আরো কাছে। আমি কয়েকবার ওখানে মাছ ধরেছি। ওটা দিয়ে উঠলে অনেকখানি কম হাঁটা লাগবে।” কার্ট ব্যাখ্যা করল।
জো দিক পাল্টে কার্টের দেখানো দিকে এগুলো। মাছ ধরা নৌকাটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দুটো অবয়ব চোখে পড়ল। ডেকের ওপর দলা হয়ে পড়ে আছে। প্রথমজন পুরুষ। আছড়ে পড়ে হাত নৌকার পাশ দিয়ে বের হয়ে আছে। অপরজন মহিলা।
“একবার কি…”।
“এরা সাহায্যের বাইরে। সামনে আগাও” কার্ট বলল।
জো কিছু বলল না। তবে নৌকাও ঘোরালো না। একটুপরই কার্টের বলা কাঠের সিঁড়িটা দেখা গেল।
নৌকাটা বাঁধতে বাঁধতে জো বলল, “নৌকাটা চুরি করার মতো কেউ বোধহয় আর বেঁচে নেই।”
দ্রুত সিঁড়ি টপকে ওঠার চেষ্টা করল ওরা কিন্তু ভারী স্যুটের কারণে পারছে না। ওপরের ধাপে পৌঁছে আরো কিছু লাশ চোখে পড়ল। এক মধ্যবয়সি দম্পতি। সাথে একটা বাচ্চা আর একটা কুকুর। রাস্তার পাশের গাছগুলোর নিচে অনেক মরা পাখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
কার্ট পাখিগুলো পেরিয়ে দম্পতির পাশে হাঁটু মুড়ে বসলো। পড়ার পরে লাগা আঘাত বাদে শরীরের আর কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।
“দেখে মনে হচ্ছে মারা যে যাচ্ছে সেটা এরা টেরও পায়নি। একেবারে সোজা মাটিতে আছড়ে পড়েছে।”
“হুম! যা-ই এটার জন্যে দায়ী, সেটা খুব দ্রুত কাজ করে।” জো বলল। কার্ট উঠে দাঁড়িয়ে জিনিসপত্র তুলে নিয়ে পরের গলিটা দেখিয়ে বলল,
“এদিক দিয়ে।”
দুই ব্লক হাঁটার পর এরা ওদের বিল্ডিংটার কাছে পৌঁছালো। বিল্ডিংটা বেশি বড় না। আপাতত NUMA তাদের অফিস হিসেবে ব্যবহার করছিল। সামনেই একটা ছোট্ট গ্যারেজ। এখন অবশ্য সাগর থেকে ওদের উদ্ধারকৃত জিনিসপত্রগুলো রাখা হয়েছে এখানে। এর পিছনেই চারটা রুম। এগুলোই ওদের অফিস আর ঘুমানোর জায়গা।