গামায় পারলে ওকে দৃষ্টি দিয়েই ভস্ম করে দেয়।
“ওদিকটা একটু দেখে আসলাম আরকি!” দেঁতো হাসি হেসে বলল পল। শেষমেশ ওরা শহরের মাঝামাঝি পৌঁছালো। পল তাড়াতাড়ি গাড়ি পার্ক করে বলল, “বাকি পথটা হেঁটেই যাই চলল।”
গামায়ও নেমে বলল, “সেটাই ভালো। নিরাপদে পৌঁছাতে পারবো তাহলে।” ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে ওরা একটা ভেজা নুড়ি পাথর বিছানো রাস্তায় এসে উপস্থিত হলো। ওটার শেষ মাথায় একটা ছোটখাটো দুর্গের মতো বাড়ি। রাস্তার দুপাশে দুটো বাঁকানো টাওয়ার। সেটা আবার একটা দেয়াল দিয়ে যুক্ত। তার মাঝে একটা ছোট দরজা। সেটা দিয়েই চলাচল করতে হয়।
“পাটের্স মরডেলাইসেস, দেয়ালের লেখা পড়তে পড়তে বলল গামায়। দরজাটা পার হতেই ওদের মনে হলো ওরা বোধহয় মধ্যযুগীয় কোনো শহরে এসে পড়েছে। অবশ্য একদিক দিয়ে সেটা সত্যিও বলা যায়। ওরা এখন আছে রেনের সবচেয়ে প্রাচীন অংশে। আর পোর্টেস মরডেলাইসেস হচ্ছে এখানকার শহরটার গুটিকয়েক টিকে থাকা ধ্বংসাবশেষের একটি।
সরু রাস্তাটা ধরে হেঁটে হেঁটে ওরা ওদের ঠিকানা মতো এসে পৌঁছালো। মাত্র ভোর হয়েছে। কিন্তু দরজায় নক করতেই পল সদ্য বানানো পাউরুটির ঘ্রাণ পেল। তার মানে বাড়িতে কেউ না কেউ জেগে আছে।
“পেট তো মোচড় দিয়ে ওঠলো। গত বারো ঘণ্টায় কিছু খাইনি।” বলল পল। দরজা খুলে দিলেন এক বৃদ্ধা-মহিলা। সব চুল সাদা হয়ে গিয়েছে। সম্ভবত নব্বই এর ঘরে বয়স। পরিপাটি পোশাক পরনে। গায়ে একটা শাল জড়ানো। ঠোঁট গোল করে ওদেরকে দেখতে লাগল।
“বনজোর, পুইস-জে ডৌস আইদ্যর?” মহিলা জিজ্ঞেস করলেন।
জবাব দিল গামায়, “বনজোর, এতেস-ভৌস মাদাম ডুশেনে?”
“ওই। পোরকুয়োই?” মহিলা বললেন।
গামায় অ্যাডমিরাল ভিয়েনেতের চিঠি সম্পর্কে আগে থেকেই ফ্রেঞ্চ ভাষায় কি বলবে ঠিক করে এসেছে। সেটাই বলল ধীরে ধীরে।
ম্যাডাম ডুশেনে মাথা কাত করে ওর কথা শুনলেন, “আপনি তো ভালোই ফ্রেঞ্চ বলেন। আমেরিকানদের মাঝে এমনটা দেখিনি। আপনারা তো আমেরিকান তাই না?” ইংরেজিতেই বললেন উনি।
“হ্যাঁ।” ইউরোপে আমেরিকানদের খুব একটা সুনজরে দেখা হয় না, সেটা গামায় জানে। কিন্তু ওদের বিদেয় না করে মাদাম ডুশেনে হেসে ওদেরকে ভেতরে যেতে বললেন।
“আসেন ভেতরে। আমি মাত্রই নাস্তা বানানো শেষ করলাম।”
গামায় পল-এর দিকে তাকাল, ওর হাসি দুকান ছাড়িয়েছে। আপনার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক।”
ম্যাডাম ডুশেনের রান্নাঘর থেকে যে সুবাস ভেসে আসছে তা অতুলনীয়। মাত্র সেকা পাউরুটি ছাড়াও তাজা এপ্রিকট, কালোজাম আর ভ্যানিলা শোভা পাচ্ছে টেবিলের ওপর।
“প্লিজ বসুন। আমার কাছে খুব একটা কেউ আসে না এখন। আপনাদেরকে দেখে ভালো লাগছে।” ম্যাডাম ডুশেনে বললেন।
ওরা রান্নাঘরেই ছোট একটা টেবিলে বসলো। আর ম্যাডাম ডুশেনে চুলার কাছে এগিয়ে ডিম ফেটা আরম্ভ করলেন। কাজের ফাঁকেই কথা বলছেন টুকটুক করে।
“আমার প্রথম স্বামীও ছিলেন আমেরিকান। সৈন্য। তার সাথে যখন দেখা হয় তখন আমার বয়স পনের। জার্মানিদের উচ্ছেদ করতে এসেছিল সে সৈন্য দলের সাথে…কালো জাম?”
“ম্যাডাম ডুশেনে। একটু অদ্ভুত শোনালেও আসলে হয়েছি কি আমরা খুব তাড়াহুড়ার মধ্যে আছি” গামায় বাধা দিল ওনার কথায়।
“কালোজাম অবশ্যই খাবো।” পল আবার বাধা দিল গামায়কে। আরো একবার পলকে ভস্ম করল গামায়। কিন্তু পলের মধ্যে এবার কোনো বিকার দেখা গেল না, “এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই।” নিচু স্বরে বলল পল। তা শুনে ম্যাডাম ডুশেনে কাজে ফিরে যেতেই আবার বলল, “নাস্তা তো করা লাগতোই। তাই না? এখানেই না হয় করলাম।”
গামায় কিছু না বলে চোখ সরিয়ে নিলো।
“কালো জাম স্বাস্থ্যের জন্যে খুবই ভালো। দীর্ঘ আয়ুর জন্যে কালোজাম খুবই উপকারী।” ম্যাডাম ডুশেনে বললেন।
“হুম! তবে যদি বৌ আগেই খুন করে ফেলে সেটা ভিন্ন কথা।” উনি না শোনার মতো করে বলল গামায়।
পল দাঁত বের করে হাসলো তারপর ম্যাডাম ডুশেনেকে বলল, “আপনার স্বামী সম্পর্কে কী যেন বলছিলেন?”
“ওহ! উনি ছিলেন সম্বা, দেখতেও বেশ! আপনার মতোই।” পলের দিকে ঘুরে বললেন ম্যাডাম ডুশেনে। কণ্ঠস্বর ছিল গ্যারি কুপারের মতো। অবশ্য আমার মতো এতোটা ভারি ও না।”
গামায় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিন্তু কিছু বলল। কেউ যদি তার স্বামীকে তেল দিতেই চায়, তাহলে নব্বই বছরের এক ফ্রেঞ্চ বৃদ্ধা হওয়াই নিরাপদ। তাছাড়া গামায় নিজেও ক্ষুধার্ত। আর মহিলা যদি পলকে পছন্দ করেই তাহলে আরো ভালো। সহজেই ওরা যেটা জানতে এসেছে সেটা বের করতে পারবে।
নাস্তার পর গামায় আসল কথাটা পাড়লো।
“আমার দাদার কাছে ছিল চিঠিগুলো। উনি অবশ্য ওগুলো সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলেননি…” ম্যাডাম ডুশেনে বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। অবশ্য নিজের বাড়িতে কাউকে যদি ছুরি দিয়ে মারা হয় তাহলে সে কথা কে-ই বা বলতে চায় বলুন। আর ভিয়েনেভেরও সুখ্যাতির চেয়ে কুখ্যাতিই ছিল বেশি।”
“কিন্তু আপনি তো ওগুলো বেচতে চেয়েছিলেন, তাই না?” গামায় জিজ্ঞেস করল।
“অনেক বছর আগে। টাকা-পয়সার দরকার পড়েছিল খুব। আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর ভয়ানক দুদর্শায় পড়ে যাই আমরা। তখনকার দিনে ঐতিহাসিক জিনিসের খুব কদর ছিল। নেপোলিয়নের সাথে সম্পর্কিত যে কোনো কিছুরই তখন খুব চাহিদা। এমনকি নেপোলিয়নের মাত্র একবার ব্যবহৃত ছুরিও দশ হাজার ফ্রান্তে বিক্রি হতো।”