লাইনটা কেটে প্রোপেন ট্যাঙ্কের দিকে এগুলো ও। তারপর একটা বাঁকা রেঞ্জ দিয়ে ট্রাঙ্কের ভালভ খুলে দিল। হিসস শব্দ করতে করতে বেরিয়ে এলো গ্যাস।
তারপর পকেট থেকে একটা ছোেট্ট বিস্ফোরক চার্জ বের করে টাইমার সেট করল। তারপর সেটা লাগিয়ে দিল ট্যাঙ্কটার গায়ে। তারপর কন্টেইনারের দরজা দিয়ে বেরিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল।
নিজের রক্তের পুকুরে শুয়ে থাকলেও ব্রাকো পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি। কি হতে যাচ্ছে পুরোটাই বুঝেছে সে। তবে যেটাই হোক মরার হাত থেকে তার বাঁচা নেই। তবে চেষ্টা করলে বিস্ফোরণটা থামাতে পারবে সে। সেই সিদ্ধান্তই নিলো মনে মনে।
গড়িয়ে উবু হলো ব্রাকো। ব্যথায় গোঙ্গাচ্ছে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে কীভাবে ও ট্রাঙ্কের কিনারে পৌঁছালো তা ও বলতে পারবে না। লাল গালিচার মতো লম্বা লাল রঙের দাগ হয়ে আছে পুরোটা। প্রথমে ও রেঞ্চটা দিয়ে ভালভটা লাগানোর চেষ্টা করল কিন্তু শক্তিতে কুলালো না। রেঞ্চটাই ঠিকমতো তুলতে পারছে না।
সেটা ফেলে তাই আবার ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগুনো শুরু করল। প্রতিবারই গঙ্গিয়ে উঠছে অমানুষিকভাবে। প্রোপেনের গন্ধে বমি বমি লাগছে ওর, আর পেটের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। চোখে ঝাপসা দেখছে বিস্ফোরকটা দেখতে পাচ্ছে কিন্তু টাইমারে লাগানো বোতামগুলোর একটাও পড়তে পারছে না। ও হাত বাড়িয়ে ওটা টান দিয়ে খুলে নিলো আর সেই মুহূর্তে আবার কন্টেইনারের দরজা শব্দ করে খুলে গেল।
ব্রাকো ঘুরে তাকাল। দুজন লোক দৌড়ে এলো, হাতে অস্ত্র, ওর দিকেই তাক করা। ওর কাছে পৌঁছাতেই ওর হাতের টাইমারটা নজরে এলো।
টাইমারের সব ডায়াল সেই মুহূর্তে ‘জিরো’-তে পৌঁছে গেছে।
ব্রাকোর হাতেই সেটা বিস্ফোরিত হলো আর গ্লোপেনে আগুন ধরে গেল। চোখ ধাঁধানো আলোয় কন্টেইনারটাও উড়ে গেল একপাশে।
বিস্ফোরণের ধাক্কায় সামনের সারির সব কন্টেইনার জায়গা থেকে নড়ে গেল, তারপর রেলিং ভেঙে গড়াতে গড়াতে সাগরের পানিতে পড়ে গেল।
ব্রাকো আর সেই দুজন লোক যেন বাষ্প হয়ে গেছে, কোনো অস্তিত্বই নেই। তবে ব্রাকো কিন্তু মিসরীর পরিকল্পনা ঠিকই ভেস্তে দিতে পেরেছে। সাথে লাগানো না থাকায় বিস্ফোরণ পুরু প্রোপেন সিলিন্ডারের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। শুধু প্রোপেনে আগুন লেগে গেছে আর হিস হিস করে প্রোপেনের সাথে আগুন বেরিয়েই যাচ্ছে।
আগুনের লকলকে শিখার সামনে যা পড়েছে তাই গলে পড়ে যাচ্ছে। এদিকে অবলম্বন না থাকায় সিলিন্ডারটা নাড়াচাড়া করতে করতে মুখটা একসময় ডেক-এর দিকে ঘুরে গেল।
প্রচণ্ড তাপে স্টিলের মেঝেও গলা আরম্ভ হলো। কয়েক মিনিট পরই সিলিন্ডারের একটা কোণা মেঝেতে দেবে গেল। আগুনের শিখা এখন আরো ভালোভাবে মেঝের দিকে ঘুরে গেল। পুরো মেঝেটাই গলে পড়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আরো বিশ মিনিট ধরে জাহাজটা জ্বলতে লাগল। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন একটা ভাসমান আগুনের গোলা। পশ্চিমে ভাসতে ভাসতে ভোরের ঠিক আগে ওটা একটা শৈল শ্রেণিতে বাড়ি খেয়ে থামল। ল্যাম্পেডুসা থেকে মাত্র আধা মাইল দূরে সেটা।
দ্বীপের সকাল বেলার পাখিরা আগুন দেখে এগিয়ে এলো, এবং ছবি তুলতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রোপেনের ট্যাঙ্কগুলোর কাছে আগুন পৌঁছে গেল আর পনের হাজার টন ঘনীভূত জ্বালানি বিস্ফোরিত হলো সবার চোখের সামনে। দূর দিগন্তের সূর্যের চেয়েও এটার উজ্জ্বলতা বেশি।
বিস্ফোরণের দমক কমতেই দেখা গেল এম. ভি. তেরিনোর পাটাতন বলে কিছু নেই। খোলটা একটা ভোলা টিনের ক্যানের মতো পড়ে আছে। তার ওপরেই কালো ধোঁয়ার একটা আস্তরণ। বাতাসে সেটা দ্বীপের দিকে ভেসে যাচ্ছে। দেখে মনে হয় হাজার বছর ধরে বৃষ্টি জমানো কোনো মেঘ বুঝি ভেসে আসছে।
কিছুক্ষণ পরই মৃত সামুদ্রিক পাখিরা আকাশ থেকে খসে পড়তে লাগল বালিতে আর সমুদ্রের পানিতে।
যারা দেখতে এসেছিল তারা প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দিল কিন্তু তার আগেই কুয়াশা তাদের ঘিরে ফেলল আর পাখিগুলোর মতো তারাও ধুপধাপ আছড়ে পড়তে লাগল।
বাতাসে ভেসে ভেসে সেই কুয়াশা দ্বীপকে উজাড় করে আরো পশ্চিমে চলে গেল। পেছনে পড়ে থাকল নিঃসীম শূন্যতা আর লাশ ভরা এক খণ্ড ভূমি।
.
০৩.
ভূমধ্য সাগর, ল্যাম্পেডুসা দ্বীপের সতের মাইল দক্ষিণপূর্ব
একটা ঝাপসা অবয়ব আলতো করে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরের বুকে। বোঝাই যায় লোকটা এতে অত্যন্ত দক্ষ এবং অভ্যস্ত। নিচ থেকে দেখলে লোকটাকে মানুষ না বরং কেমন স্বর্গীয় দূত বলে ভ্রম হয়। শরীরের দুপাশে দুটো স্কুবা টাঙ্ক ঝোলানো, পিঠে পেটমোটা একটা ব্যাগ মত জিনিস, একটা প্রপালশন ইউনিটও বাধা পিঠের সাথে। তাতে এক জোড়া ছোট্ট পাখা। কাঁধে দুটো লাইট ঝোলানো। ওটার হলদেটে আলো ভৌতিক আবহ ছড়িয়ে আশেপাশের অন্ধকারকে চিরে দিছে।
প্রায় একশো ফুট নিচে সমুদ্রের তলের কাছাকাছি পৌঁছে লাইটটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিচটা দেখতে লাগল সে। কমলা রঙের পোশাক পরা কিছু ডুবুরি সেখানে কিছু একটার ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারে ব্যস্ত। জিনিসটা উদ্ধার হলে রোম আর কার্থেজদের মধ্যকার ঐতিহাসিক পিউনিক যুদ্ধের ইতিহাসের নতুন একটা দিক উন্মোচিত হবে।
লোকগুলোর থেকে প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূরে সমুদ্র তলে নেমে দাঁড়ালো লোকটা, তারপর বাম বাহুতে ঝোলানো ইন্টারকমের সুইচ টিপে দিল।