ডেস্কের নিচে কিছু একটা পড়ে ছিল, পায়ে লাগল। পিছিয়ে এসে ঝুঁকলেন অসকার, জিনিসটা তুলে নিলেন। একটা নাইন-মিলিমিটার, পিস্তল। ট্রাউজারের ওয়েস্ট ব্যান্ডে ঢুকিয়ে রাখলেন তিনি।
সার্চ শেষ করে ব্রিজে ফিরে এলেন অসকার। চার্টরুমে বসে রয়েছে সাকাগাওয়া, পা দুটো ছোট একটা কেবিনেটে তুলে দিয়ে জাহাজের লগ পড়ছে। পেরেছ তাহলে? জানতে চাইলেন তিনি।
খোলা একটা ব্রীফকেসে, লগের প্রথম দিক থেকে পড়তে শুরু করল। সাকাগাওয়া। ডিভাইন স্টার, সাতশো ফুট, ১৬ মার্চ ১৯৮৮-তে ডেলিভারি। সুশিমো স্টীমশিপ কোম্পানি লিমিটেড-এর জাহাজ, হেড অফিস কোবে। চলতি ভয়েজে আমরা সাত হাজার দুশো অষ্টাশিটা মূরমোটো অটোমোবাইল বহন করে সান ফ্রান্সিসকোয় নিয়ে যাচ্ছি।
ক্রুরা জাহাজ ছেড়ে চলে গেল কেন, কোন সূত্র পেয়েছ? জানতে চাইলেন অসকার।
মাথা নাড়ল সাকাগাওয়া। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মহামারী, বিদ্রোহ কিছুই বলা হয়নি। ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে কোন রিপোর্ট নেই। শেষ এন্ট্রিটা একটু অদ্ভুত।
পড়ো।
নিজে আরেকবার পড়ে নিল সাকাগাওয়া, অনুবাদে যাতে ভুল না হয়। তারপর বলল, আমি যতটুকু অর্থ করতে পারছি আবহাওয়ার অবস্থা খারাপের দিকে। ঢেউয়ের উচ্চতা বাটুছে। ক্রুরা অজ্ঞাত রোগে ভুগছে। ক্যাপটেনসহ সবাই অসুস্থ। সন্দেহ করা হচ্ছে ফুড পয়জনিং। আমাদের প্যাসেঞ্জার, মি. সুমা, কোম্পানি ডিরেক্টরদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, উন্মাদের মত আচরণ করছেন। তার বক্তব্য, জাহাজ ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত আমাদের, জাহাজটা ডুবিয়ে দেয়া দরকার। ক্যাপটেন বলছেন, মি. সুমা নার্ভাস ব্রেকডাউনে ভুগছেন; নির্দেশ দিয়েছেন তাকে যেন তার কোয়ার্টারে আটকে রাখা হয়। এ থেকে আমি তো কিছুই বুঝলাম না, স্যার।
ভাবলেশহীন চেহারা, অসকার জানতে চাইলেন, ব্যাস, আর কিছু নেই?
না, স্যার, আর কিছু নেই।
তারিখ?
পয়লা অক্টোবর।
তার মানে দুদিন আগের ঘটনা।
মাথা ঝাঁকাল সাকাগাওয়া, অন্যমনস্ক। এরপরই বোধহয় জাহাজ ছেড়ে চলে যায় ওরা। আশ্চর্য লগটাও ওরা সাথে করে নিয়ে যায়নি।
শান্ত পায়ে কমিউনিকেশন রুমের দিকে এগোলেন অসকার, গভীরভাবে চিন্তা করছেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি, নিজেকে স্থির রাখার জন্যে হাত বাড়িয়ে দরজার চৌকাঠটা ধরে ফেললেন। পুরো ঘরটা তার চোখের সামনে মনে হলো যেন। দুলছে। বমি বমি একটা ভাবও অনুভব করলেন।
গলা বেয়ে তরল পদার্থ উঠে আসছে, বুঝতে পেরে ঢোক গিলে নিচে পাঠিয়ে দিলেন সেটাকে। হামলাটা হঠাৎ যেমন শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেল।
এলোমেলো পা ফেলে রেডিওর সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি, নারভিকের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। দিস ইজ ফাস্ট অফিসার অসকার কলিং ক্যাপটেন কোরভোল্ড। ওভার।
বলো, অসকার, জবাব দিলেন ক্যাপটেন কোরভোল্ড। কি খবর?
সার্চ করার দরকার নেই, তাতে শুধু সময় নষ্ট হবে। ডিভাইন স্টারের লগে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় পুরোপুরি শুরু হবার আগেই জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে ক্রুরা। চলে গেছে দুদিন আগে। ইতোমধ্যে বাতাস তাদেরকে দুশো কিলোমিটার দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে।
যদি তারা বেঁচে থাকে?
সম্ভাবনা কম।
ঠিক আছে, অসকার। তোমার সাথে আমি একমত, আমরা সার্চ করলে কোন লাভ নেই। আমাদের যতটুকু করার করেছি আমরা। ইতোমধ্যে আমি মিডওয়ে আর হাওয়াই-এর আমেরিকান সী রেসকিউ ইউনিটগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছি, আশপাশে যারা আছে তাদেরকেও। তোমরা সচল হলে আমরাও সান ফ্রান্সিমকোর কোর্স ধরব।
ঠিক আছে, অসকার বললেন। অ্যান্ডারসন কতটুকু কি করতে পারল দেখার জন্যে আমি এখন এঞ্জিন রুমে যাচ্ছি।
যোগাযোগ কেটে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে যাবেন তিনি, জাহাজের একটা ফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে অসকার বললেন, ব্রিজ।
মি, অসকার, দুর্বল একটা গলা ভেসে এল।
হ্যাঁ, কি হয়েছে?
সীম্যান আর্নি মিডগার্ড, স্যার। আপনি এখুনি একবার সি কার্গো ডেকে আসতে পারবেন? এখানে আমি একটা জিনিস পেয়েছি…।
হঠাৎ ঠেকে গেল মিডগার্ডের গলা। সে বমি করছে, শুনতে পেলেন অসকার। আর্নি, তুমি অসুস্থ?
প্লীজ, তাড়াতাড়ি করুন, স্যার! তারপরই যোগাযোগ কেটে গেল। সাকাগাওয়ার দিকে ফিরে চিৎকার করলেন অসকার, এঞ্জিন রূমের সাথে যোগাযোগ করতে হলে কোন বোতামটায় চাপ দেব?
সাকাগাওয়া কথা বলল না। চাৰ্টরমে ফিরে এলেন অসকার। আগের মতই চেয়ারে বসে রয়েছে সাকাগাওয়া, তার মুখ মরার মত ফ্যাকাসে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। মুখ তুলে তাকাল সে, কথাও বলল, প্রতিবার দম নেয়ার সময় বাতাসের অভাবে হাঁসফাস করছে। চার নম্বর বোতামটা… এঞ্জিন রুমে…।
কি হয়েছে তোমার? ব্যাকুলকণ্ঠে জানতে চাইলেন অসকার।
জানি না… আমি… আমার খারাপ লাগছে… ভয়ানক অসুস্থ বোধ করছি… বমি করেছি দুবার…।
শান্ত হও, ধমক দিলেন অসকার। সবাইকে ডাকছি আমি। এটা একটা ডেথ শিপ, নেমে যাব আমরা। ছো দিয়ে ফোন তুলে যোগাযোগ করলেন এঞ্জিন রুমের সাথে। কিন্তু এঞ্জিন রূম থেকে কেউ সাড়া দিল না। ভয়ে কুঁকড়ে গেল তার মন। অজানা একটা ভয়, তাদের ওপর হামলা করছে। তার মনে হলো গোটা জাহাজে ভেসে বেড়াচ্ছে মৃত্যুর একটা তীব্র গন্ধ।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলেন অসকার। রাণকহেডে বসানো একটা ডেক ডায়াগ্রাম-এর উপর চোখ বুলালেন। পরমুহূর্তে ক্যানিয়নওয়ে ধরে নিচে নামতে শুরু করলেন, প্রতিবারে ছয়টা করে ধাপ টপকে। প্রকাণ্ড হোল্ডগুলোর দিকে ছুটতে চাইছেন তিনি, যেখানে গাড়িগুলো আছে, কিন্তু বমির একটা ভাব তার পেটের পেশীগুলোকে কঠিন করে তুলল। প্যাসেজে দাঁড়িয়ে টলতে শুরু করলেন তিনি, দেয়ালে বাড়ি খেতে খেতে এগোচ্ছেন, যেন একটা বন্ধ মাতাল।