এন্ডারসন বলল, আমি বরং নিচে নেমে গিয়ে দেখি ওগুলো বন্ধ করা যায় কিনা। ব্যাটা বোরটকে বলল, পানি সেচতে শুরু করুক। দুজন সীম্যানকে নিয়ে কম্পানিয়নওয়ে ধরে ছুটল সে, এঞ্জিন রামের দিকে যাচ্ছে।
বাকি সীম্যানের একজন অসকার স্টিনের কাছে এসে দাঁড়াল, অবিশ্বাস ও বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে আছে চোখ দুটো, মুখের রঙ কাগজের মত সাদা। স্যার… আমি একটা লাশ পেয়েছে। সম্ভবত রেডিওম্যান…।
দ্রুত কমিউনিকেশন রুমে চলে এলেন অসকার। রেডিও ট্রান্সমিটার প্যানেলের দিকে ঝুঁকে চেয়ারে সময় হয়তো মানুষই ছিল সে, কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে মানুষ বলার কোন উপায় নেই। শরীরের কোথাও কোন চুল নেই। যেখানে ঠোঁট ছিল সেখানে সবগুলো বেরিয়ে থাকা দাঁত না থাকলে অসকার বলতে পারতেন না আকৃতিটা সামনে তাকিয়ে আছে নাকি পিছনে। বীভৎস একা দৃশ্য, দেখে মনে হলো, ফোঁসকা পড়ার পর গায়ের সমস্ত চামড়া গলে গেছে, নিচের মাংসও খানিকটা পুড়ে ও খানিকটা গলে গেছে।
অথচ আশপাশে কোথাও সামান্যতম উত্তাপ বা আগুনের চিহ্নমাত্র নেই। লোকটার গায়ের কাপড় এত পরিস্কার ও এত সুন্দর ভাঁজ করা, যেন এইমাত্র ইস্ত্রি করার পর পরেছে।
লোকটা যেন তার শরীরের ভেতরকার উত্তাপে পুড়ে গেছে।
.
০২.
উৎকট দুর্গন্ধে বমি পেল চীফ অফিসারের। নিজেকে সামলাতে পুরো এক মিনিট সময় নিলেন তিনি। তারপর চেয়ারসহ লাশটাকে একপাশে সরিয়ে ঝুঁকে পড়লেন রেডিওর দিকে। কয়েকবার ভুল করার পর নির্দিষ্ট সুইচটা খুঁজে পেলেন, যোগাযোগ করলেন নারভিকের ক্যাপটেন কার্নি কোরভোল্ডের সাথে।
কোরভোন্ড জানতে চাইলেন, কি দেখলে বলল, অসকার।
এখানে মারাত্মক কিছু একটা ঘটে গেছে, ক্যাপটেন। শুধু একটা লাশ ছাড়া এখনও আর কাউকে দেখিনি আমরা। জাহাজটা পরিত্যক্ত। লাশটা রেডিওম্যানের। পোড়া, চেনা যায় না।
তার মানে কি আগুন ধরেছিল?
আগুনের কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই। কমপিউটারাইজড অটোমেটেড কন্ট্রোল সিস্টেমের স্ক্রীনে, ফায়ার ওয়ার্নিং লেখাটার নিচে সবুজ আলো জ্বলছে।
এমন কোন লক্ষণ দেখছ যাতে বোঝা যায় কি কারণে লাইফবোট নিয়ে চলে গেছে ক্রুরা? কোরভোন্ড জানতে চাইলেন।
সেরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু বোঝা যায়, তাড়াহুড়ো করে পালাবার সময় জাহাজটা ডুবিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে গেছে।
ফোন ধরা হাতের গিটগুলো সাদা হয়ে গেল, গম্ভীর হলেন ক্যাপটেন কোরভোন্ড। আবার বলো।
সী ককগুলো খোলার পর এমনভাবে আটকানো হয়েছে যে কমপিউটার ওগুলো বন্ধ করতে পারছে না। বন্ধ করা যায় কিনা হাত দিয়ে চেষ্টা করে দেখছে। এন্ডারসন।
কয়েক হাজার গাড়ি বহন করছে। এটা একটা অক্ষত জাহাজ, কেন ওটাকে ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হবে? বেসুরো গলায় জিজ্ঞেস করলেন কোরভোন্ড।
কিছুই বুঝতে পারছি না, স্যার। এখানে অস্বাভাবিক কিছু একটা আছে। রেডিও অপারেটরের লাশটা বীভৎস। তাকে যেন আগুনে ঝলসানো হয়েছে।
তুমি চাও আমাদের ডাক্তারকে পাঠাব?
পোস্টমর্টেম ছাড়া এখানে তার কিছু করার নেই, স্যার।
বুঝলাম। স্টেশনে আরও ত্রিশ মিনিট আছি, তারপর নিখোঁজ বোটগুলো সার্জ করতে বেরুব।
কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করেছেন, স্যার?
ক্রুদের কেউ বেঁচে থাকলে আমাদের স্যালভেজ ক্লেইম চ্যালেঞ্জ করতে পারে, এ কথা ভেবে অপেক্ষা করছি। তল্লাশি চালিয়ে দেখো, সত্যিই যদি জাহাজটা পরিত্যক্ত হয়, আমাদের কোম্পানির ডিরেক্টরকে মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়ে দেব যে ডিভাইন স্টারের দখল নিতে যাচ্ছি আমরা।
এঞ্জিনিয়ার এন্ডারসন সী কক বন্ধ করছে, পাম্প করে পানিও বের করে দেয়া হচ্ছে। পাওয়ার সাপ্লাই ঠিক আছে, কাজেই কিছুক্ষণের মধ্যে রওনা হতে পারব আমরা।
যত তাড়াতাড়ি করতে পারো ততই ভাল, কোরোল্ড বললেন। তোমরা একটা ব্রিটিশ ওশেনোগ্রাফিক সার্ভে ভেসেল-এর দিকে ভেসে যাচ্ছে। ওরা স্থির একটা পজিশনে রয়েছে।
কতদূরে?
প্রায় বারো কিলোমিটার।
তাহলে ওরা নিরাপদ দূরত্বেই আছে।
বলার মত আর কিছু খুঁজে পেলেন না ক্যাপটেন কোরভোন্ড। অবশেষে শুধু বললেন, গুড লাক, অসকার। আমি চাই বন্দরে নিরাপদে পৌঁছুবে তোমরা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
রেডিও থেকে মুখ তুললেন চীফ অফিসার অসকার, চেয়ারে বসে থাকা গলা লাশটার দিকে তাকালেন না। ভয়ে একা ঠাণ্ডা স্পর্শ অনুভব করলেন তিনি, শিরশির করে উঠল গা। পরিত্যক্ত জাহাজের মত ভৌতিক আর কিছু হয় না, ভাবলেন তিনি। সাকাগাওয়াকে নির্দেশ দিলেন, জাহাজের লগ খুঁজে বের করো, দেখো অনুবাদ করতে পারো কিনা। অবশিষ্ট দুজন সীম্যানকে অটো ডেক সার্চ করতে পাঠালেন, নিজে রওনা হলেন ক্রুদের কোয়ার্টার পরীক্ষা করতে। তাঁর মনে হলো, তিনি যেন একটা পোড়াবাড়ির ভেতর হাঁটছেন।
কিছু কাপড়চোপড় এলোমেলোভাবে পড়ে আছে, সেগুলো ছাড়া বাকি সবকিছু দেখে মনে হলো ক্রুরা যে-কোন মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে। কোথাও কোন অসঙ্গতি চোখে পড়ল না, যেখানে যা থাকার সবই ঠিকমত আছে। ক্যাপটেনের কোয়ার্টারে একটা ট্রের ওপর দুটো চায়ের কাপ রয়েছে, কিভাবে যেন ঝড়ের মধ্যে ছিটকে পড়েনি। বিছানার পড়ে রয়েছে একটা ইউনিফর্ম। কার্পেটে মোড়া ডেকে পাশাপাশি রাখা হয়েছে পালিশ করা দুপাটি জুতো। পরিচ্ছন্ন ডেস্কের উপর পড়ে রয়েছে একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি নাবালক তিনটে বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক মহিলা।