ডেনিংস ও টিবেটস, দুজন কমান্ডার কেউই পরস্পরের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়। দুজনেরই ধারণা, শুধু তার প্লেন ও তার ক্রুরাই যুদ্ধ থামানোর জন্যে দুনিয়ার বুকে প্রথম অ্যাটম বোমা ফেলতে যাচ্ছে।
ডেনিংস ডেমনস তার গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলো। সাগরের তলায় এক সময় স্থির হয়ে গেল বিধ্বস্ত প্লেনটা। ঘটনাটার কথা দুনিয়ার লোককে জানানো হলো না। গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে সমস্ত তথ্য চেপে যাওয়া হলো।
.
প্রথম পর্ব
বিগ জন্
৩ অক্টোবর, ১৯৯১,
পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর।
০১.
প্রচণ্ড টাইফুন থেমে গেছে। সাগরের সেই উন্মত্ততা এখন আর নেই, তবে ঢেউগুলো এখনও জাহাজের বো-র নাগাল পেতে চাইছে, মাঝে মধ্যেই লাফ দিয়ে উঠে পড়ছে ডেকে, পিছনে রেখে যাচ্ছে একরাশ সাদা ফেনা। ঘন কালো মেঘে ভাঙন ধরল, বাতাসের তেজ কমে দাঁড়াল ত্রিশ নটে। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একটা সুড়ঙ্গের মত খাড়া হয়ে নিচে নামল রোদ, ফুলে-ফেঁপে থাকা ঢেউগুলোর ওপর এঁকে দিল নীল একটা বৃত্ত।
নরওয়ের রিনডাল লাইনস্ প্যাসেঞ্জার-কার্গো লাইনার নারভিকের ডেকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ক্যাপটেন আর্নি কোরভোল্ড, চোখে দূরবীন, ঢেউ ও সাদা ফেনার মাথায় নৃত্যরত বিশাল একটা জাহাজের ওপর চোখ বুলাচ্ছেন। চেহারা দেখে মনে হলো, ওটা একটা জাপানি অটো ক্যারিয়ার ব্রিজ আর আপার ডেকে ক্রুদের কোয়ার্টার ছাড়া আর কোথাও কোন পোর্ট বা জানালা নেই।
জাহাজটা দশ ডিগ্রির মত কাত হয়ে আছে, ঢেউয়ের ধাক্কায় সেটার মাত্র দাঁড়াচ্ছে বিশ ডিগ্রি। চিমনি থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, জীবনের চিহ্ন বলতে ওইটুকুই। একটা লাইফবোটও দেখা যাচ্ছে না, তার মানে নামানো হয়েছে ওগুলো। গম্ভীর হয়ে উঠল ক্যাপটেন কোরভোন্ডের চেহারা। অশান্ত সাগরের কোথাও কোন লাইফবোটের চিহ্নমাত্র নেই। দূরবীন ঘুরিয়ে জাহাজটার নাম আরেকবার পড়লেন তিনি। জাপানিরা সাধারণত ইংলিশ নাম রাখে তাদের জাহাজের, এটাও তার ব্যতিক্রম নয়।
জাহাজটার নাম ডিভাইন স্টার।
বাতাস ও পানির ঝাপটা থেকে সেন্টাল ব্রিজে ফিরে এলেন কোরভোল্ড, কমিউনিকেশন রূমে উঁকি দিয়ে জানতে চাইলেন, এখনও কোন সাড়া নেই?
মাথা নাড়ল রেডিও অপারেটর। না, স্যার। আমরা ওটাকে দেখার পর থেকে ওরা কোন শব্দই করছে না। ওটার রেডিও নিশ্চয়ই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কোন সাহায্য না চেয়ে জাহাজ খালি করে চলে গেছে সবাই, এ অবিশ্বাস্য।
ব্রিজের জানালা দিয়ে নিঃশব্দে জাপানি জাহাজটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন ক্যাপটেন কোরভোল্ড, নারভিকের স্টারবোর্ড রেইল থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে ওটা। নরওয়েতে জন্ম, ক্যাপটেন কোরভোন্ড অত্যন্ত ধীরস্থির প্রকৃতির মানুষ, তাড়াহুড়া করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া তার স্বভাব নয়। ছাব্বিশ বছর সাগরে আছেন তিনি, প্যাসেঞ্জার ও ক্রুরা তাকে সম্মান করে। কাঁচা-পাকা ছোট দাড়িতে হাত বুলালেন তিনি, চিন্তা করছেন। কোরিয়া থেকে সান ফ্রান্সিসকোয় যাচ্ছে নারভিক, ঝড়ের মধ্যে পড়ে শিডিউল থেকে পিছিয়ে পড়েছে দুদিন। গত আটচল্লিশ ঘণ্টা ব্রিজ থেকে নড়েননি ক্যাপটেন, প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করছেন। পরিবেশ একটু ভাল হয়ে আসার পর ভাবছিলেন এবার একটু বিশ্রাম নেয়া যেতে পারে, ঠিক এই সময় ডিভাইন স্টারকে দেখতে পেয়েছেন তারা।
ডিভাইন স্টারের লাইফবোটগুলোকে এখন খুঁজতে হবে। এটা আসলে মানবিক একটা দায়িত্ব, এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। আবার, নিজের প্যাসেঞ্জারদের কথাও ভাবতে হবে তাঁকে সবাই তারা সী সিকনেসে ভুগছে। কোন উদ্ধার অপারেশনে তারা উৎসাহি হবে বলে মনে হয় না।
ওটায় এটা বোর্ডিং পার্টি পাঠাবার অনুমতি দেবেন, ক্যাপটেন?
চীফ অফিসার অসকার স্টিন-এর দিকে তাকালেন ক্যাপটেন। হালকা-পাতলা গড়ন চীফ অফিসারের, নীল চোখে বৃদ্ধির দীপ্তি। সঙ্গে সঙ্গে জবাব না দিয়ে ব্রিজের একটা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন কোরভোন্ড, দুই জাহাজের মাঝখানে ঢেউগুলোর দিকে তাকালেন। একেকটা ঢেউ তিন থেকে চার মিটার উঁচু। আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাইনি, অসকার। এসো, বরং আরও খানিকটা অপেক্ষা করি, সাগর আগে শান্ত হোক।
এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে বোট নিয়ে পানিতে নেমেছি আমরা, ক্যাপটেন, মনে করিয়ে দিলেন চীফ অফিসার।
তাড়াহুড়োর কি আছে। ওটা তো একটা মরা জাহাজ, মর্গে পড়ে থাকা লাশের মত। দেখে মনে হচ্ছে ওটার কার্গো কাত হয়ে পড়ছে, পানিও ঢুকছে। ওটাকে বাদ দিয়ে আমাদের উচিত লাইফবোটগুলোর খোঁজ করা।
ওখানে আহত মানুষ থাকতে পারে, যুক্তি দেখালেন চীফ অফিসার।
মাথা নাড়লেন কোরভোল্ট। জাহাজ খালি করার সময় কোন ক্যাপটেন তার আহত ক্রুদের ফেলে যাবে না।
হ্যাঁ, যদি তার মাথার ঠিক থাকে। কিন্তু ভেবে দেখুন, ঘণ্টায় পঁয়ষট্টি নট ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে কোন ডিসট্রেস সিগন্যাল না দিয়ে অক্ষত একটা জাহাজ থেকে বোটে করে যাকে পালাতে হয়, তার কি মাথা ঠিক থাকার কথা?
হ্যাঁ, একটা রহস্য বটে একমত হলেন কোরভোল্ড।
ওটার কার্গোর কথাও বিবেচনা করতে হবে, বললেন চীফ অফিসার অসকার স্টিন। ওয়াটার লাইন বলে দিচ্ছে, জাহাজটা পুরোপুরি লোড করা। দেখে মনে হচ্ছে সাত জাহাজের বেশি বইতে পারে ওটা।
চোখ কুঁজকে চীফ অফিসারের দিকে তাকালেন ক্যাপটেন। তুমি স্যালভেজ এর কথা ভাবছ, অসকার?