গতি সামান্য কমেছে, সেঁটা টুকে নিয়ে দ্রুত একটা হিসাব করল আরনল্ড, জানাল, মেইনল্যান্ডে পৌঁছতে লাগবে এক ঘণ্টা একশ মিনিট।
মাথা ঝাঁকাল ডেনিংস। ঠিক আছে, আপাতত আমরা চার নম্বর বন্ধ করে দেব।
পাইলটের কথা শেষ হয়নি, তার আগেই এটল বন্ধ করে ইগনিশন সুইচ অফ করে দিল স্ট্রম্প, তারপর এনগেজ করল অটোমেটিক পাইলট।
পরবর্তী আধঘণ্টা সবাই সতর্ক একটা চোখ রাখল চার নম্বরের ওপর। টেমপারেচার কমছে, একটু পরপরই ওদেরকে জানাল মোসলে।
মাটি দেখতে পাচ্ছি, এক সময় বলল আরনল্ড। নাক বরাবর বিশ মাইল সামনে একটা দ্বীপ।
চোখে দূরবীন তুলে তাকাল স্ট্রম্প। যেন সাগর ফুড়ে বেরিয়ে আছে একটা স্যান্ডউইচ।
আরনল্ড বলল, খাড়া পাথুরে পাঁচিল। কোথাও সৈকত দেখা যাচ্ছে না।
কি নাম দ্বীপটার? জানতে চাইল ডেনিংস।
ম্যাপে ওটা নেই।
প্রাণের কোন চিহ্ন দেখতে পাচ্ছ? জাপানিরা হয়তো অফ-শোর ওয়ার্নিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করছে।
উঁহু, দেখে মনে হচ্ছে একদম ফাঁকা ও নির্জন।
আপাতত নিরাপদ বোধ করল ডেনিংস। এখন পর্যন্ত শত্রুপক্ষের কোন জাহাজ চোখে পরেনি। জাপানি তীর থেকে অনেক দূরে রয়েছে ওরা, শত্রুদের কোন ফাইটার এতটা দূরে বাধা দিতে আসবে না। নিজের সীটে বসে সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকল সে।
কফি আর স্যান্ডউটচ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল সবাই। খুদে একটা বিন্দুর অস্তিত্ব। সম্পর্কে কেউই সচেতন নয়। ওদের পোর্টউইং-এর ডগা থেকে সাত হাজার ফুট ওপরে ওটা। দশ মাইল দূরে।
ডেনিংস ডেমনরা জানে না, আর মাত্র কয়েক মিনিট বেঁচে আছে ওরা।
.
লেফটেন্যান্ট জুনিয়র গ্রেড সাতো ওকিনাগা তার অনেক নিচে মুহূর্তের জন্যে কি যেন একটা ঝিক করে উঠতে দেখেছে। আকাশে কিছু ঝিক করে উঠতে পারে শুধু রোদ লাগলে, কাজেই আরও কাছ থেকে দেখা দরকার জিনিসটা কি। ডাইভ দিল সে। সন্দেহ নেই, ওটা একটা প্লেন। সম্ভবত অন্য কোন পেট্রল-এর প্লেন। রেডিও অন করার জন্যে হাত বাহিরেও থেকে গেল সে। আর কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে দেখলে ক্ষতি নেই। রেডিও অন করার আগে প্লেনটা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দরকার।
তরুণ ও অনভিজ্ঞ পাইলট হলেও, সাতো ওকিনাগা ভাগ্যবান বটে। তাদের ব্যাচে বাইশজন ছাত্র ছিল, ট্রেনিং শেষ করার পর তিনজন বাদে বাকি সবাইকে পাঠানো হয়েছে সুইসাইড স্কোয়াড্রনে। ওদের তিনজনকে উপকূল পাহারা দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এ ধরনের প্রায় ঝুঁকিবিহীন দায়িত্ব পেয়ে দারুণ হতাশ হয়েছে ওকিনাগা। সম্রাটের জন্যে প্রাণ বিসর্জন দেয়ার একটা ব্যাকুলতা ছিল তার মধ্যে। কিন্তু হুকুম হুকুমই, তার ওপর কথা চলে না। আপাতত এই একঘেয়েমিতে ভরা দায়িত্ব পালন করলেও, তার আশা কিছুদিনের মধ্যে আরও বড় কোন কাজের জন্যে ডাকা হবে তাকে।
নিঃসঙ্গ প্লেনটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে আকারে, সেই সঙ্গে অবিশ্বাসে বড় হচ্ছে ওকিনাগার চোখ দুটো। ভুল দেখছে নাকি? চোখ রগড়াল সে। একটু পরই পালিশ করা ৯০ ফুট অ্যালুমিনিয়াম ফিউজিলাজ, বিশাল ১৪১ ফুট ডানা, তিনতলা বিশিষ্ট খাড়া স্ট্যাবিলাইজার চিনতে পারল সে। ওটা একটা আমেরিকান বি টোয়েনটিনাইন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল সে। উত্তর পূর্বে দিকের খালি একটা সাগর থেকে উড়ে আসছে প্লেনটা, কমব্যাট সিলিঙের ২০০০ ফুট নিচ দিয়ে। উত্তরবিহীন প্রশ্নগুলো ভিড় করল তার মনে। কোত্থেকে এল ওটা? একটা এঞ্জিন বন্ধ রেখে কেন ওটা মধ্য জাপানের দিকে যাচ্ছে? ওটার মিশন কি হতে পারে?
অযথা সময় নষ্ট করা উচিত হবে না তার। বিশাল ডানাসহ বোমারুটা সামনে ঝুলে রয়েছে। মিতসুবিশি এসিক্স এম, জিরো প্লেনটার থ্রটল বিরতিগুলোয় না থামিয়ে টানল সে, বৃত্ত রচনার সঙ্গে সঙ্গে ডাইভ দিল নিচের দিকে।
ফাইটারটাকে দেরিতে দেখতে পেল গানার, যদিও দেখার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার করল সে। দেরি করল না ওকিনাগাও, জিরোর দুটো মেশিনগান ও একজোড়া টোয়েনটি মিলিমিটার কামান গর্জে উঠল।
ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও মানুষের মাংস দলা পাকিয়ে একাকার হয়ে গেল। জিরোর ট্রেসারগুলো ডানা ভেঙে ভেতরে ঢুকল, বি-টোয়েনটিনাইনের তিন নম্বর এঞ্জিনটাকে আঘাত করল। একাধিক গর্ত থেকে হড়হড় করে বেরিয়ে এল ফুয়েল। তারপরই আগুন ধরে গেল এঞ্জিনটায়। মুহূর্তের জন্যে শূন্যে ইতস্তত করল বোমারু, তারপর চিৎ হয়ে গেল, ডিগবাজি খেতে খেতে নামতে শুরু করল সাগরে। লেফটেন্যান্ট ওকিনাগা একটা ডানার ওপর খাড়া করল জিরোকে। আহত বি টোয়েনটিনাইনকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে। কালো ধোয়া আর কলা শিখা মোচড় থেকে খেতে উঠে আসছে আকাশে। প্লেনটাকে সাগরে পড়তে দেখল সে, লাফ দিয়ে উঠল সাদা পানি।
আরও কিছুক্ষণ চক্কর দিল সে, কেউ বেঁচে আছে কিনা জানতে চায়। আবর্জনা ছাড়া কিছুই তার চোখে পড়ল ন। উল্লাসে অধীর হয়ে আছে ওকিনাগা, ফাইটার পাইলট হিসেবে এটাই তার প্রথম সাফল্য। ধোয়ার দিকে শেষ একবার তাকিয়ে নিজের এয়ারপোর্টের দিকে ফিরে চলল সে। রিপোর্ট করতে হবে।
.
ডেনিংসের বিধ্বস্ত প্লেন যখন এক হাজার ফুট পানির নিচে সাগরের তলায় স্থির। হচ্ছে, অপর একটা বি-টোয়েনটিনাইন অন্য এক টাইম জোন-এ ছয়শো মাইল দক্ষিণ পূর্বে; একই ধরনের একটা বোমা নিয়ে চুটে চলেছে কর্নেল পল টিবেটস রয়েছে কন্ট্রোলে, তার এনোপলা গে জাপানি শহর হিরোশিমার ওপর পোঁছে গেছে।