ডেনিংসকে একটা কোর্স জানাল আরনল্ড, নেভিগেটর। এই কোর্স ধরে আগামী সাড়ে দশ ঘণ্টা ছুটবে প্লেনটা। চার হাজার নয়শো ফুটে উঠে কো-পাইলটের হাতে কন্ট্রোল ছেড়ে দিল ডেনিংস। সীটে হেলান দিয়ে পেশী শিথিল করল সে, কালো আকাশের দিকে তাকাল। কোথাও একটা তারা নেই। ঘন মেঘের ভেতর দিয়ে ছুটছে ওরা। প্লেন ঝাঁকি খাচ্ছে দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে বাতাসের দাপট ক্রমশ বাড়ছে।
ঝড়ের প্রবল মারমুখী অংশটা থেকে বেরিয়ে এল প্লেন, এতক্ষণে সেফটি বেল্ট খুলে সিট থেকে উঠল ডেনিংস। শরীরটা মুচড়ে ঘুরল সে, পোর্টসাইডের একটা জানালা দিয়ে প্লেনের কোমর ও লেজের দিকটা দেখতে পেল। রিলিজ মেকানিজমে ঝুলন্ত বোমাটার অংশবিশেষ চোখে পড়ে গেল তার।
টানেলে ঢুকে বম্ব-বেকে পাশ কাটাল ডেনিংস, অপরদিকে পৌঁছে লাফ দিয়ে নিচে নামল। ছোট্ট, এয়ারটাইট দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে। লেগ পকেট থেকে টর্চলাইট বের করে জ্বালল, ক্যাটওয়াক ধরে হাঁটছে। দুটো বম্ববে জোড়া লাগিয়ে এক করা হয়েছে, ক্যাটওয়াকটা তারই ওপর। দাঁড়াল সে, এক সেকেন্ড ইতস্তত করে বোমাটায় হাত রাখল। আঙুলের ডগায় ইস্পাতের গা বরফের মত ঠাণ্ডা। মাত্র এক সেকেন্ডের মধ্যে লাখ লাখ মানুষকে ছাই করতে পারে এই বোমা? বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো তার। শুধু তাই নয়, পরবর্তী সেকেন্ডগুলোয় মারা পড়বে আরও লাখ লাখ মানুষ হয় পুড়ে, নয়তো রেডিওশেনে আক্রান্ত হয়ে। সাদা-কালো মুভি ফিল্মে ট্রিনিটি টেস্ট দেখলেও, শক ওয়েভের থার্মোনিউক্লিয়ার টেমপারেচার অনুভব করা সম্ভব নয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডেনিংস ভাবল, আমি কোন অপরাধ করছি না কারণ আমি চাই যুদ্ধটা বন্ধ হোক, চাই নিজের দেশের লাখ লাখ মানুষকে বাঁচাতে।
ককপিটে ফিরে এসে বায়ারনেসের সঙ্গে গল্প শুরু করল সে। বোমার ডিটোনেশন সার্কিট দেখছে বায়ারনেস, হাতে একটা ছক কাটা নকশা। মাঝে মধ্যেই সামনে রাখা ঘোট কনসোল-এর দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছে অর্ডন্যান্স এক্সপার্ট।
ওখানে পৌঁছানোর আগেই ফেটে যেতে পারে, এমন কোন সম্ভাবনা আছে নাকি? জানতে চাইল ডেনিংস।
বাজ পড়লে ফাটতে পারে, জবাব দিল বায়ারনেস।
আঁতকে ওঠে তার দিকে তাকাল ডেনিংস। কথাটা অনেক দেরি করে বলছ, নয় কি? সেই মাঝ রাত থেকে একটা বিদ্যুৎ বহুল ঝড়ের ভেতর রয়েছি আমরা।
মুখ তুলে নিঃশব্দে হাসল বায়ারনেস। বাজ তো আঘাত করতে পারত আমরা যখন মাটিতে ছিলাম তখনও। কি আসে যায়, আমরা তো প্রায় পৌঁছে গেছি, তাই না?
সবার চেয়ে ভালভাবে জানেন। তিনি তো অ্যাটমিক বম্ব প্রজেক্টে শুরু থেকেই জড়িত।
শিউরে উঠল ডেনিংস, ঘুরে দাঁড়াল। এ স্রেফ পাগলামি, ভাবল সে। গোটা অপারেশনটাই আসলে পাগলামি। এই পাগলামির কথা বলার জন্যে ওরা যদি কেউ বেঁচে থাকে, সেটা হবে নেহাতই মিরাকল।
.
ইতোমধ্যে চাচ ঘণ্টা উড়ে ২০০০ হাজার গ্যালন ফুয়েল খরচ করেছে প্লেনটা। বি টোয়েনটিনাইনকে ১০০০০ ফুটে সিধে করল ডেনিংস। পুবের আকাশে ভোরে ম্লান আলো ফুটতে ক্রুরা একটু নড়েচড়ে বসল। ঝড়টা ওদের অনেক পিছনে রয়েছে, ছড়ানো-ছিটানো সাদা মেঘের নিচে উত্তাল সাগর দেখতে পাচ্ছে ওরা।
অলস ভঙ্গিতে, ২২০ নটে, দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে যাচ্ছে ডেনিংস ডেমনস। লেজে হালকা একটু বাতাস পাচ্ছে ওরা, সেজন্যে খুশি সবাই। দিনের আলো ফোঁটার পর উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল শূন্যতা দেখতে পেল ওরা। মনে হলো গোটা পৃথিবীতে, সাগর আকাশের মাঝখানে, একা শুধু তারাই আছে।
জাপানের প্রধান দ্বীপ, হনশু থেকে তিনশো মাইল দূরে এসে ধীরভঙ্গিতে আকাশের আরও ওপরে উঠতে শুরু করল ডেনিংস। ৩২০০০ ফুটে উঠে যাবে সে। ওসাকায় পৌঁছে এই উচ্চতা থেকেই বোমাটা ফেলবে হার্ব স্ট্যানটন। নেভিগেটর আরনল্ড জানাল, নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বিশ মিনিট এগিয়ে আছে তারা। বর্তমান গতিবেগের হিসেবে এখন থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর ওকিনাওয়ায় ল্যান্ড করবে প্লেন।
ফুয়েল গজের দিকে তাকাল ডেনিংস। হঠাৎ খুশি হয়ে উঠল মনটা। বাতাস অনুকূল থাকায় চারশো গ্যালন ফুয়েল অবশিষ্ট থাকতেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবে ওরা।
সবাই তার মত খুশি নয়। এঞ্জিনিয়ারের প্যানেলের সামনে বসে চার নম্বর এঞ্জিনের টেমপারেচার গজ পরীক্ষা করছে মোসলে। প্রতি মুহূর্তে আরো গম্ভীর হয়ে উঠছে তার চেহারা। নিয়মিত টোকা দিয়ে যাচ্ছে সে।
লার ঘরে পৌঁছে থরথর করে কাঁপছে কাঁটাটা। টানেল দিয়ে ক্রল করে সামনে এগোল মোসলে, একটা পোর্ট দিয়ে এঞ্জিনের তলায় তাকাল। এঞ্জিনের বহিরাবরণ তেলে ভিজে আছে, ধোঁয়া বেরুচ্ছে এগজস্ট থেকে। ককপিটে ফিরে এসে পাইলট ও কো-পাইলটের মাঝখানে হাঁটু গেড়ে উঁচু হলো সে। খবর খারাপ, মেজর, বলল সে। চার নম্বর এঞ্জিন বন্ধ করতে হবে।
আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা ওটাকে চালু রাখা যায় না? জানতে চাইল ডেনিংস।
না, স্যার একটা ভালব গিলে ফেলতে পারে, যে-কোন মুহূর্তে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে।
আমিও বলি, কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে চার নম্বরকে ঠান্ডা করা হোক, বলল কো পাইলট স্ট্রম্প।
দ্রুত একটা হিসাব করল ডেনিংস। এই মুহূর্তে ১২০০০ ফুটে রয়েছে ওরা। ওভারহিটিং হবার আশঙ্কা আছে, কাজেই তিনটে সচল এঞ্জিন নিয়ে আরও ওপরে ওঠা উচিত হবে না। চার নম্বর ঠাণ্ডা হোক, আবার ওটা চালু করা হবে ৩২০০০ ফুটে ওঠার সময়। গ্যাবনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে। নেভিগেটর আরনল্ড বোর্ডের দিকে ঝুঁকে ফ্লাইট পাথ ট্রেস করছে। ডেনিংস জানতে চাইল, জাপান আর কত দূরে?