কো-পাইলট জানাল, টাওয়ার থেকে টেকঅফের ক্লিয়ার্যান্স পাওয়া গেছে। থ্রাপস নিচু করল সে। ফ্ল্যাপ সেটিং ঠিক আছে, রিপোর্ট করল দুজন ক্রু। হাত বাড়িয়ে ইন্টারকমের সুইচ অন করল ডেনিংস। ওকে, বন্ধুরা, আমরা রওনা হলাম।
থ্রটলটা আবার ধীরে ধীরে সামনে বাড়াল সে। তারপর ব্রেক রিলিজ করল।
প্লেনটার ধারণ ক্ষমতা আটষট্টি টন। সাত হাজার গ্যালন ফুয়েল থাকায় ট্যাংকগুলো কানায় কানায় ভরে আছে। প্লেনের ফরওয়াড়র্প বম্ব-বেতে রয়েছে ছয় টন ওজনের বোমাটা। সব মিলিয়ে ক্রুর সংখ্যা বারো। প্লেন এগোতে শুরু করল। প্রায় সতেরো হাজার পাউন্ড অতিরিক্ত বোঝা বহন করছে।
চারটে রাইট সাইক্লোন এঞ্জিন, প্রতিটি তিন হাজার তিনশো পঞ্চাশ কিউবিক ইঞ্চি। ১৬.৫ ফুট প্রপেলারগুলোকে ঘোরাচ্ছে আট হাজার আটশো বর্স পাওয়ার। বিশাল বোমারুটা সগর্জনে অন্ধকারের ভেতর ছুটল।
আতঙ্ককর অলস একটা ভঙ্গিতে গতি বাড়ছে ওটার। সামনে লম্বা হয়ে আছে রানওয়ে, পাথর কেটে তৈরি করা, শেষ মাথায় কিছু নেই, পাহাড়ের খাড়া গা ঝাঁপ করে নেমে গেছে আশি ফুট নিচের সাগরে। ডান দিক থেকে বাম দিকে ছুটন্ত বিদ্যুতের একটা চোখ ধাঁধানো চমক উজ্জ্বল নীল আলোয় ভাসিয়ে দিল রানওয়ের দুপাশে ফাঁক ফাঁক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ফায়ার ট্রাক ও অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে। প্লেনের গতি এখন আশি নট, হুইলটা শক্ত করে চেপে ধরল ডেনিংস, প্লেনটাকে আকাশে তোলার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
পাইলটদের সামনে, বাইরের দিকে বেরিয়ে থাকা নাকের অংশে বম্বারডিয়ার হার্ব স্ট্যানটন দেখতে পাচ্ছে দ্রুত ছোট হয়ে আসছে রানওয়ে। ছটফটে মর্ট স্টম্প সিট ছেড়ে প্রায় দাঁড়িয়ে পড়ল, অন্ধকার ভেদ করে রানওয়ের কিনারাটা দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করছে সে।
চার ভাগের তিন ভাগ রানওয়ে পিছনে ফেলে এসেছে ওরা। এখনও মাটি কামড়ে রয়েছে প্লেন। সময় যেন আঙুলের ফাঁকগলে বেরিয়ে যাচ্ছে। একই অনুভূতি হলো সবার, ওরা যেন অতল শূন্য গহ্বরে ঢুকে পড়ছে। তারপর রানওয়ের শেষ মাথার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জফগুলোর আলো বৃষ্টির পর্দা ভেদ করে অকসাৎ ঝলসে উঠল।
গড অলমাইটি! গুঙিয়ে উঠল স্ট্রম্প।প্লেনটাকে তোলো!
আরও তিন সেকেন্ড অপেক্ষা করল ডেনিংস, তারপর শান্তভাবে হুইলটাকে নিজের বুকের দিকে টেনে আনল। বি-টোয়েনটিনাইনের চাকা মাটি ছাড়ল। পিছিয়ে পড়ল রানওয়ের কিনারা, মাত্র ত্রিশ ফুট ওপরে উঠে এসেছে প্লেন।
.
রাডার ঘর থেকে বেরিয়ে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন জেনারেল মরিসন, তাঁর। পিছনে স্টাফরাও দাঁড়িয়ে। ডেনিংস ডেমনসের টেকঅফ যতটা না চোখ দিয়ে দেখলেন তিনি তার চেয়ে বেশি দেখলেন কল্পনায় সাহায্যে।
হাত দিয়ে কান ঢেকে এঞ্জিনের আওয়াজ শুনলেন মরিসন, অন্ধকারের ভেতর দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। শব্দে একটা ছন্দপতন ঘটছে, তবে তা খুবই অস্পষ্ট। অভিজ্ঞ ফ্লাইট মেকানিক বা একজন এয়ারক্রাফট এঞ্জিনিয়ার ছাড়া আর কেউ ধরতে পারবে না। সামরিক জীবনের শুরুতে এই দুই পেশাতেই দক্ষতা অর্জন করেছেন জেনারেল।
একটা এঞ্জিন সামান্য বেসুরো আওয়াজ করছে। আঠারোটার মধ্যে এক বা একাধিক সিলিন্ডার ঠিকমত কাজ করছে না। মনে আতঙ্ক, কান পেতে থাকলেন। জেনারেল, এমন একটা লক্ষণ পেতে চাইছেন যা থেকে বোঝা যাবে প্লেনটা টেকআপ করবে না। টেকআপ করার সময় ডেনিংস ডেমনস বিধ্বস্ত হলে দ্বীপটার সমস্ত কিছু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ছারখার হয়ে যাবে।
তারপর রাডার ঘরের দরজা থেকে অপারেটর চিৎকার করে বলল, আকাশে উঠে গেছে।
নিঃশ্বাস ফেলার সময় থরথর করে কেঁপে উঠল জেনারেলের শরীর। ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি, ফিরে যাচ্ছেন ঘরে। এখন আর তার কিছু করার নেই, ওয়াশিংটনে জেনারেল গ্রোভসকে শুধু একটা মেসেজ পাঠাতে হবে, জানাতে হবে যে মায়ের নিঃশ্বাস জাপানের পথে রওনা হয়ে গেছে। সবাইকে এখন অপেক্ষা করতে হবে। থাকতে হবে ভয় মেশানো আশা নিয়ে।
জেনারেল মরিসন ঘরের ভেতর পায়চারি শুরু করলেন। ডেনিংসকে তিনি চেনেন। জেদি লোক, একটা এঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দিলে ফিরবে না সে। পিঠে করে বয়ে নিয়ে যেতে হলেও ডেমনসকে ওসাকায় নিয়ে যাবে।
ঈশ্বর সাহায্য কর, বিড়বিড় করলেন জেনারেল, যদিও জানে যে এই অপারেশনে তার যে ভূমিকা, ঈশ্বর তাঁর প্রার্থনা কবুল করবেন না।
গিয়ার আপ, নির্দেশ দিল মেজর ডেনিংস।
শব্দগুলো শুনে আগে কখনও এত আনন্দ লাগেনি, বলে লিভারটা সরাল স্ট্রম্প। গিয়ার মটর গুঞ্জন তুলল, তিন সেট চাকা ঢুকে পড়ল নাক আর ডানার নিচে খোপের ভেতর। গিয়ার আপ অ্যান্ড লক।
এয়ারস্পীড বাড়ল, ফুয়েল বাঁচানোর জন্যে থ্রটল সেটিং নামিয়ে আনল ডেনিংস। এয়ারস্পীড দুশো নটে পৌঁছল, এবার ধীরে ধীরে আকসামের আরও ওপরে তুলল প্লেনটাকে। স্টারবোর্ডের দিকে রয়েছে অ্যালুসিয়ান দ্বীপমালা, যদিও দেখা যাচ্ছে না। আড়াই হাজার মাইলের মধ্যে আর কোন মাটিই ওরা দেখতে পাবে না। চার নম্বর এঞ্জিনের খবর কি? জানতে চাইল সে।
নিজের দায়িত্ব ঠিকমতই পালন করছে, তবে একটু বেশি গরম বলে মনে হচ্ছে, জবাব দিল মোসলে।
পাঁচ হাজার ফুটে উঠি, ওটার কিছু আরপিএম কমিয়ে আনব।
ক্ষতি নেই, মেজর, মন্তব্য করল এঞ্জিনিয়ার মোসলে।