ডিসপ্লে বোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন ইন্টেলিজেন্স অফিসার, বোর্ডে দেখানো হয়েছে টার্গেটের এরিয়াল ফটোগ্রাফ। ওসাকার শিল্পাঞ্চল প্রধান টার্গেট। আকাশে ভারী মেঘ থাকলে টার্গেট বদলে যাবে, বোমাটা তখন ফেলতে হবে ঐতিহাসিক নগরী কাইয়োটায়। দুটো পথই ম্যাপে দেখিয়ে দেয়া হলো। শান্তভাবে নোট নিল ডেনিংস।
আবহাওয়া দফতরের একজন কর্মকর্তা ওয়েদার চার্ট সটলেন বোর্ডে। উল্টোদিক থেকে হালকা বাতাস থাকবে, থাকবে ছড়ানো-ছিটানো মেঘ। উত্তর জাপানের দিকে বাতাসের তীব্রতা সম্পর্কে ডেনিংসকে সতর্ক করে দিলেন তিনি। সাবধানের মার নেই ভেবে একজোড়া বি-টোয়েনটিনাইনকে এক ঘণ্টা আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, ফ্লাইট ফুটের ওপরে আবহাওয়ার অবস্থা ও টার্গেট পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, ফ্লাইট রুটের ওপরে আবহাওয়ার অবস্থা ও টার্গেট দুটোর ওপর মেঘের অবস্থা দেখে রিপোর্ট করবে তারা।
পোলারাইজড ওয়েল্ডার গগলস দেয়া হলো সবাইকে। তারপর ক্রুদের সামনে দাঁড়াল ডেনিংস। গা-গরম করা বক্তৃতা আমার আসে না, বলল সে, লক্ষ করল স্বস্তিসূচক নিঃশব্দ হাসি ফুটল তার ক্রুদের মুখে। এক বছরের ট্রেনিং মাত্র এক মাসে সারতে হয়েছে আমাদের, তবে আমি জানি যে এই মিশনে সফল হবার যোগ্যতা আমরা রাখি। কোন রকম গর্ব না করেও বলতে পারি যে এয়ার ফোর্সে তোমরাই সেরা ফ্লাইট ক্রু। আমরা যদি যে যার কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে পারি, এই অভিশপ্ত যুদ্ধটা থামতে পারে। কথা শেষ করে ধর্মযাজকের দিকে তাকাল সে। মিশনের নিরাপত্তা ও সাফল্যের জন্যে প্রার্থনা করেন তিনি।
প্লেনের উদ্দেশে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ক্রুরা, ডেনিংসের সামনে এসে দাঁড়ালেন জেনারেল হারল্ড মরিসন। পাইলটের চোখের চারধারে ক্লান্তির ছাপ, তবে চোখ দুটো উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন জেনারেল। গুড লাক, মেজর।
“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। কাজটা আমরা ভালভাবে শেষ করব।
মুহূর্তের জন্যেও সন্দেহ করি না, মরিসন বললেন, চেহারায় জোর করে ফুটিয়ে তুললেন দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। পাইলট কিছু বলবে, সেই আশায় অপেক্ষা করে থাকলেন তিনি। কিন্তু ডেনিংস চুপ করে থাকল।
অস্বস্তিকর কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল। তারপর নিস্তব্ধতা ভাঙল ডেনিংস। আমরা কেন, জেনারেল?”
মরিসনের মুখে হাসি দেখা গেল কি গেল না। তুমি পিছু হটতে চাও, মেজর?
না। কাজটা আমরা করব। কিন্তু দায়িত্বটা আমরা কেন পেলাম? দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করল ডেনিংস। কথাটা বলার জন্যে ক্ষমা করবেন, জেনারেল, তবে এ বিশ্বাস করা কঠিন যে গোটা এয়ার ফোর্সে শুধু আমরাই এ কাজের জন্যে যোগ্য ও বিশ্বস্ত বিবেচিত হয়েছি। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে আরও অনেক পাইলট প্লেন নিয়ে যাওয়া-আসা করছে, একটা অ্যাটম বোমা বয়ে নিয়ে যাওয়ার মত লোক তাদের মধ্যে নেই? বোমাটা ফেলতে হবে জাপানের মাঝখানে, তারপর ল্যান্ড করতে হবে ওকিনাওয়া-য়, এ-ও তেমন কঠিন কোন কাজ নয়, যদিও ল্যান্ড করার সময় ফুয়েল ট্যাংকে খানিকটা ফেনা ছাড়া আর কিছু থাকার কথা নয়।
এত কথার উত্তরে জেনারেল মরিসন শুধু বললেন, যতটুকু তোমরা জানো তার বেশি না জানাই তোমাদের জন্যে ভাল।
যাতে আমরা ধরা পড়লে টপ সিক্রেট ইনফরমেন ফাঁস করতে না পারি?
গম্ভীর হলেন জেনারেল মরিসন। তুমি ও তোমার ক্রুরা অশুভ পরিণতি সম্পর্কে জানো। তোমাদের প্রত্যেককে একটা করে সায়ানাইড ক্যাপসুল দেয়া হয়েছে। তবে আমি জানি তোমাদের মিশনের শুভ সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে।
বলা হয়েছে, শত্রু এলাকায় প্লেন ক্যাশ করার পর কেউ বেঁচে থাকলে ক্যাপসুলটা গিলে ফেলতে হবে, বলল ডেনিংস। আচ্ছা, বোমাটা সাগরে ফেলে দিলে অসুবিধে কোথায়? তাতে অন্তত নৌ-বাহিনী আমাদেরকে উদ্ধার করার একটা সুযোগ পাবে।
চেহারায় গাম্ভীর্য ও বিষণ্ণতা, মাথা নাড়লেন জেনারেল। অস্ত্রটা শত্রুদের হাতে পড়ার সামান্য সম্ভাবনার কথাও আমরা ভাবতে পারি না।
আচ্ছা, বিড়বিড় করল ডেনিংস। সে জন্যেই আমাদের বিকল্প হলো, জাপানের মেইনল্যান্ডের ওপর আকাশে থাকার সময় আমরা যদি গুলি খাই, যতটা সম্ভব নিচে নেমে বোমাটা ফাটিয়ে দিতে হবে।
মরিসন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। এটা সুইসাইডাল মিশন নয়। তোমার ও তোমার ক্রুদের নিরাপত্তার জন্যে সম্ভাব্য সমস্ত দিক বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। ওসাকায় “মায়ের নিঃশ্বাস” ফেলা আসলে পানির মত সহজ একটা কাজ।
মুহূর্তের জন্যে হলেও, জেনারেলের কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো ডেনিংসের। কিন্তু তাঁর চোখে বিষণ্ণতার ছায়া দেখে নিজের ভুলটা বুঝতে পারল সে। মায়ের নিশ্বাস, ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল, বেসুরো গলায়, যেন কল্পনাতীত কোন আতঙ্ক তাকে গ্রাস করতে যাচ্ছে। কে সে, বোমাটার এ ধরনের একটা কোড নেম কার মাথা থেকে বেরুল?
সামান্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে জেনারেল বললেন, সম্ভবত প্রেসিডেন্টের মাথা থেকে।
.
সাতাশ মিনিট পর উইন্ডস্ক্রীনের সচল ওয়াইপারের দিকে তাকাল ডেনিংস। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে, আবছা ও ভেজা অন্ধকারে মাত্র দুশো গজ সামনে পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে সে। এঞ্জিনগুলোকে দুহাজার দুশো আরপিএম পর্যন্ত তুলল, দুটো পা-ই চেপে রেখেছে ব্রেকের ওপর। ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার সার্জেন্ট মোসলে রিপোর্ট করল, চার নম্বর আউটবোর্ড এঞ্জিন পঞ্চাশ আরপিএম কম গতিতে কমে থাকার জন্যে, সন্দেহ নেই, ভেজা বাতাসই দায়ী। এটল টেনে এঞ্জিনগুলোকে শান্ত করল সে, তবে সচল রাখল।